দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে মামলার শুনানি, রায় ও আদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ছে।
আগে বাংলায় রায় ও আদেশের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলা ভাষায় আদেশ ও রায় দেয়ার চর্চা বাড়ছে। দিনে দিনে এ চর্চা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এখন ওয়েবসাইটে সুপ্রিমকোর্টের সব রায় বাংলায় দেখা যাবে। ইংরেজি ভাষায় দেয়া সুপ্রিমকোর্টের সব রায়-আদেশ বাংলা ভাষায় দেখাতে প্রযুক্তিসেবা সংযোজন করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ২০ ফেব্রুয়ারি সোমবার এ প্রযুক্তিগত সেবার উদ্বোধন করেন
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা জানান, এ প্রযুক্তির সংযোজন ও উদ্বোধন বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক সময়োপযোগী নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ প্রযুক্তিসেবা উদ্বোধনের পর সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন জানায়, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত সব রায়-আদেশ গুগলের প্রযুক্তির সহায়তায় আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, বা যেকোনো ব্যক্তি নিজে নিজেই বাংলায় অনুবাদ করে দেখতে পারবেন। এ জনমুখী প্রযুক্তি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে এমনভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি ইংরেজি ভাষায় দেয়া যে কোনো রায় বা আদেশ, তা যত বড়ই হোক না কেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তা বাংলায় অনুবাদ করে দেখতে পারছেন।
সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন আরও জানায়, সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিচারপতি নিয়মিতভাবে বাংলা ভাষায় রায়-আদেশ দিয়ে থাকেন। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত ‘আমার ভাষা’ নামে প্রযুক্তির মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রদত্ত রায়-আদেশ বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে ২০২১ সাল থেকেই।
দেশের নিম্ন আদালতে কিছু কিছু ক্ষেত্র ছাড়া শুনানিসহ বেশির ভাগ মামলায় রায় ও আদেশ বাংলায় দেয়া হয়। বৃটিশ ল’এর আধিক্যসহ নানা কারণে সুপ্রিমকোর্টে ইংরেজি চর্চা সুদৃঢ় ছিল। দিনে দিনে সুপ্রিমকোর্টে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনজীবীদের বাংলায় শুনানি ও যুক্তি পেশ ত্বরান্বিত হচ্ছে। ইংরেজীর পাশাপাশি শুনানিকালে আদালতের নানা জিজ্ঞাসায়ও দেখা যায় বাংলার ব্যবহার।
ভাষার জন্য লড়াইয়ের মাস চলতি ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্ট বিচারপতি এম, ইনায়েতুর রহিম বাংলায় আদেশ ও সিদ্ধান্ত দেয়া শুরু করেন, যা আপিল বিভাগে দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথম। হাইকোর্ট বিভাগের দুজন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় হাইকোর্ট বিভাগে বেশ ক’জন বিচারপতি বাংলায় রায়-আদেশ দিয়েছেন।
উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় দেয়া হয় একটি বেঞ্চে নব্বই দশকে। প্রয়াত বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী নব্বইয়ের দশকে হাইকোর্টে বাংলায় আদেশ দেয়া শুরু করেন। এরপর সাবেক বিচারপতিদের মধ্যে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক, বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বেশ কয়েকটি রায় বাংলায় দেন। বিচারপতি খায়রুল হক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, চার নদী সংরক্ষণসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় বাংলায় দেন।
বর্তমানে বিচারপতি এম, ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগে) রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালে বাংলায় রায় লিখেছেন। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি থাকাকালে বিচারপতি এম, ইনায়েতুর রহিম বাংলায় অসংখ্য রায় ও আদেশ দিয়েছেন। আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথেরও (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) হাইকোর্টে থাকাকালে মামলায় বাংলা রায় দেয়ার নজির রয়েছে।
আপিল বিভাগের বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী হাইকোর্টে থাকাকালে বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় বাংলা রায় দেন। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিমের (বর্তমানে আপিল বিভাগে) নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলায় রায় ও আদেশ দেয়া শুরু করেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন বাংলায় রায়-আদেশ দিচ্ছেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল বাংলায় রায়-আদেশ দেন। বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট বিভাগে আরো বেশ কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন- বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহ, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী, বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান, বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান, বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা চর্চা সমৃদ্ধ করতে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। সাইনবোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে বাংলা ব্যবহার বিষয়ে রায় রয়েছে উচ্চ আদালতের। যদিও এ রায় পুরোপুরি বাস্তবায়নে এখনো ঘাটতি বিদ্যমান।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আনোয়ারুল ইসলাম শাহীন বলেন, আমাদের মাতৃভাষা বাংলার রয়েছে সমৃদ্ধ ও গৌরবের ইতিহাস। দেশের প্রচলিত আইনগুলো বাংলা ভাষায় নিশ্চিত করতে হবে। আদালতের রায় ও আদেশ বাংলায় হলে সাধারণ মানুষেরও বুঝতে সুবিধা হয়। উচ্চ আদালতে এখন বাংলায় রায় দেয়া বাড়ছে। ফলে বিচারপ্রার্থীরা স্বাচ্ছন্দ অনুভব করছেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতসহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাকে আরো সমৃদ্ধ করতে এর চর্চা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, ইংরেজী, স্প্যানিস, চাইনিজ, জাপানিজ, জার্মানি, আরবি, হিন্দি ভাষা যেমনি বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে তেমনি আমরাও পারি বাংলাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো সমৃদ্ধ করতে। শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা বিশ্বমন্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন এবং দিনে দিনে আরো এগিয়ে যাচ্ছেন। এদেশে যেমন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাড়ছে তেমনি বাংলাদেশীরাও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছেন। এ সূযোগে বাংলাকেও পৌছেঁ দিতে হবে বিশ্বমন্ডলে। আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে বিশ্ব শান্তি মিশনে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশী সেনারা সেখানে বাংলাকেও পৌছেঁ দিয়েছেন। এ উদাহরণ তুলে ধরে ব্যারিস্টার শাহিন বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি সাফল্যেরে উদহারণ। এটি আমাদের অনুসরণ করতে হবে। ইংরেজীসহ বিভিন্ন বিদেশী ভাষা রপ্ত করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রবণতা রয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে এটিও প্রয়োজন। পাশাপশি মাতৃভাষা বাংলার চর্চা ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুদৃঢ় করতে মনোযোগী হতে হবে আমাদের সকলকে। এতে করে বিশ্বমন্ডলে আমাদের ঐতিয্য ও সংস্কৃতি আরো সমৃদ্ধ হবে।
সূত্র: বাসস
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন