সাম্প্রতিক সময়ে ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের মনে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমন্তবর্তী এলাকায় ৭.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ব্যাপক বিধ্বংসী এই ভূমিকম্পের ফলে জানমাল ও অবকাঠামোগত অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তৃত এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। ধ্বংসস্তূপ সরালেই মিলছে মানুষের লাশ। ৭০টির বেশি দেশের উদ্ধারকর্মীগণ উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। ভূমিকম্পে কত লোক যে মারা গেছে, তার সঠিক হিসাব এখনো হয়নি। ইতোমধ্যে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ভূমিকম্পের পরে সিরিয়ায় ৫৩ লাখ মানুষ গৃহহীন হতে পারে। এখন তুরস্ক ও সিরিয়ার ৯ লাখ লোকের জরুরি খাদ্য প্রয়োজন। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, তুরস্ক ও সিরিয়ার এই ভূমিকম্প চলতি শতাব্দীর ষষ্ঠ প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে উঠেছে। এর আগে আছে ২০০৫ সালে পাকিস্তানে হওয়া ভূমিকম্প, যেটিতে ৭৩ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের দেশে গত ১৫ বছরে ছোট বড় মিলে মোট ১৪১ বার ভূকম্পন হয়েছে। কম্পন দীর্ঘ সময় ধরে হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টিকে মোটেও হাল্কাভাবে দেখার সুযোগ নেই। ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্প অনেক সময় বড় ধরনের ভূমিকম্পের লক্ষণ হতে পারে। বড় ভূমিকম্পের শত বছরের মধ্যে আরেকটি বড় ভূমিকম্প হয়। সেদিক থেকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কতটা প্রস্তুত এই বড় ধরনের ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকবেলা করার ক্ষেত্রে?
ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যার পূর্বাভাস দেয়ার উপায় এখনো বিজ্ঞানীরা বের করতে পারেনি। আমাদের দেশের প্রধান প্রধান শহরে মানুষ বাড়ার পাশাপাশি আবাসিক-অনাবাসিক স্থাপনা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। সেইসব স্থাপনা কতটা মান সম্পন্ন, বড় ধরনের ভূমিকম্পে সেগুলো টিকে থাকবে কি না, এই আশঙ্কা প্রবল। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে প্রয়োজনীয় খোলা জায়গাও নেই আমাদের বড় শহরগুলোতে। অভিযোগ রয়েছে, দেশে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয় না। ফলে মাঝারি ধরনের ভূমিকম্পও মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। আর বড় ধরনের ভূমিকম্প ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। তাই ভূমিকম্পের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে সব ধরনের স্থাপনা এ দুর্যোগ মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।
ভূমিকম্পকে বলা হয়, জীবন, সম্পদ, নগর ও সভ্যতা বিনাশক। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমার টেকটনিক প্লেটের মাঝে আবদ্ধ। টেকটনিক প্লেটের অবস্থান দেখলে বোঝা যায় যে, আমাদের উত্তর-পূর্বে দুটো বর্ডার বা টেকনিক্যাল ভাষায় ‘ভূ-চ্যুতি’ রয়েছে, যা বাংলাদেশের ভূমিকম্পের কারণ পারে। এজন্য উত্তরপূর্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর সিলেট ও তৎসংলগ্ন এলাকা প্রবল ভূমিকম্পপ্রবণ। এর পরের অংশগুলোও যেমন- ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম অঞ্চলও ভূমিকম্পপ্রবণ। এ অবস্থায় ভূমিকম্পের পর উদ্ধার প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি যতটুকু থাকা দরকার, তার প্রায় কিছুই নেই বললেই চলে। উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তির যেমন অভাব রয়েছে, তেমনি প্রযুক্তিগত দিক থেকেও পিছিয়ে আছি আমরা। এসব দিকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া অধিক জরুরি।
পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ছয় হাজার ভূমিকম্প হয়। তবে এগুলোর অধিকাংশই মৃদু যেগুলো আমরা টের পাই না। সাধারণত তিন ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে- প্রচন্ড, মাঝারি ও মৃদু। আবার উৎসের গভীরতা অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা যায়Ñ অগভীর, মধ্যবর্তী ও গভীর ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ভূপৃষ্ঠের ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে অগভীর, ৭০ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে হলে মধ্যবর্তী এবং ৩০০ কিলোমিটারের নিচে হলে গভীর ভূমিকম্প বলে।
সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। প্রথমত: ভূপৃষ্ঠজনিত, দ্বিতীয়ত: আগ্নেয়গিরিজনিত ও তৃতীয়ত: শিলাচ্যুতিজনিত। ভূমিকম্পের মাত্রা মাপা হয় রিখটার স্কেলে। রিখটার স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫ এর বেশি হওয়া মানে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা। মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্প এক মাত্রা বৃদ্ধি পেলেই এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৫-৫.৯৯ মাঝারি, ৬-৬.৯৯ তীব্র, ৭-৭.৯৯ ভয়াবহ, ৮-এর উপরে অত্যন্ত ভয়াবহ।
বিশ্বে সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার একটি হলো চিলি। সেখানে ১৯৬০ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী (রিখটার স্কেলে ৯.৫ মাত্রা) ভূমিকম্প হয়। তাই চিলি ধীরে ধীরে তাদের সব বিল্ডিং ভূমিকম্প সহনীয় করে গড়ে তুলেছে। সে কারণে বড় ভূমিকম্পতেও সেখানে ক্ষয়ক্ষতি খুব কম হয়। ২০১৫ সালে চিলিতে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল, যাতে মানুষ মারা যায় মাত্র ১৩ জন। অথচ, হাইতিতে ২০১০ সালে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় তিন লাখ মানুষ মারা যায়। এর প্রধান কারণ দুর্বল স্থাপনা। হাইতিতে বলতে গেলে ভূমিকম্প সহনীয় বিল্ডিং নেই, তাই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হয় ব্যাপক।
এ প্রেক্ষিতে বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ জাপানের কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো। ২০১১ সালের ১১ মার্চ সেদেশের তহুকু রিজিওনে প্রায় ৯ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয় তাতে রাজধানী টোকিও শহরেও ঝাঁকুনি লেগেছিল প্রায় ৭ মাত্রায়। কিন্তু এতেও রাজধানীতে বহুতল অট্টালিকাগুলো ধসে যাওয়ার বা মানুষ নিহত হবার ঘটনা ঘটেনি। নির্মাণ শিল্পে ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তি রক্ষাকবচ হিসেবে একটা পর্যায় পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যকর, এমনকি বিরল শক্তিমাত্রার কম্পনেও (৯ মাত্রার) ক্ষয়ক্ষতি কমাতে দারুণ ভূমিকা রাখে।
ভূমিকম্প প্রস্তুতিতে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ জাপান। ২০১১ সালের তহুকু ভূমিকম্পটি ছিল জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাত্রার আর বিশ্বে পঞ্চম। অতি দ্রুত ধেয়ে আসা সুনামি ছিল ধ্বংসযজ্ঞের মূল কারণ, যা সমস্ত প্রস্তুতি কার্যক্রমকে অকার্যকর করে দিয়েছিল। এটা যদি ঘণ্টা খানেক সময় দিত, নিহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যেত। ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের দুর্ঘটনা সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তুলেছিল।
২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্প আর মনিপুরের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের পর বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিপর্যয়ের আশঙ্কার মধ্যেই বাংলাদেশিদেরও বসবাস করতে হবে। এখানে শহরাঞ্চলে মূল ক্ষয়ক্ষতি হবে স্থাপনা ধসে। মর্মান্তিক এক পরিণতির আশঙ্কায় ভীতির সঙ্গে বসবাসের চেয়ে কঠিন সময় কঠিনতম দৃঢ়তায় মোকাবেলা করার প্রত্যয় নিয়ে প্রস্তত থাকতে হবে।
বাংলাদেশের স্থাপনাসমূহ নিয়েও এরকম শঙ্কা রয়েছে। তাই ক্ষয়ক্ষতি যাতে কম হয় সেজন্য সরকার প্রণীত বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করা হলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে। এছাড়া বিপদ মোকাবেলায় সাধারণ মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা এবং নিয়মিত মহড়া ও স্বেচ্ছাসেবক তৈরির উপরও গুরুত্ব দিতে হবে।
ভূমিকম্পের সময়ে যা করতে হবে: ১. ভূমিকম্প হচ্ছে বুঝতে পারলে জীবন বাঁচাতে হলে প্রথমে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে হবে। কোনভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। ২. বাসাবাড়িতে থাকলে মাথা বালিশ দিয়ে ঢেকে টেবিল, খাট বা শক্ত কোনো আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিন। ৩. ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির অন্যতম কারণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ থেকে লাগা আগুন। তাই দ্রুততার সঙ্গে রান্নঘরের গ্যাসের চুলা, ঘরের বৈদ্যুতিক সুইচগুলো বন্ধ করতে হবে। ৪. ভূমিকম্পের সময় খালি পায়ে নয়, শক্ত জুতা পরে চলফেরা করতে হবে, যাতে গ্লাস, মেটাল ইত্যাদির ইনজুরি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ৫. ব্যাটারি চালিত রেডিও, টর্চলাইট বা ম্যাচ-মোমবাতি, পানি, শুকনো খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সব সময় ঘরে রাখা প্রয়োজন। ৬. গ্যাস লিকেজ আছে কি না তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ম্যাচ-মোমবাতি জ্বালানো নিষেধ। ৭. হুইল চেয়ারে থাকলে, চাকা লক বা বন্ধ করে হাত দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখতে হবে। ৮. স্কুল, কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকলে স্কুলব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত টেবিলের নিচে অশ্রয় নিতে হবে। ৯. ভূমিকম্পের সময় বহুতল ভবন থেকে নামতে হলে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে। কোনক্রমেই লিফট ব্যবহার করা যাবে না। লিফটে থাকলে নিকটবর্তী ফ্লোরে তাড়াতাড়ি নেমে পড়তে হবে। ১০. বেশি উপরতলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে খোলা জায়গায় বা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিতে হবে। তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে নামা যাবে না। ১১. শিল্প-কারখানা, হাসপাতাল, মার্কেট, সিনেমা হলে থাকলে হুড়োহুড়ি করে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় বা ধাক্কধাক্কি করা যাবে না। যেখানে অবস্থান সেখানেই দুহাতে মাথা ঢেকে বসে থাকতে হবে। ১২. গাড়িতে থাকলে রাস্তা ব্লক না করে একপাশে থেমে যেতে হবে। ব্রিজ, ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, বিলবোর্ড ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে। ১৩. বড় গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি ইত্যাদি থেকে দূরে খোলা স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। ১৪. সমুদ্র বা নদীর ধারে থাকলে যথাশীঘ্র দ্রুততার সঙ্গে উঁচু জায়গায় অবস্থান নিতে হবে। ১৫. একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে খালি জায়গায় চলে যেতে হবে।
মানুষ মানুষের জন্য। বিপদের সময় মনুষ্যত¦ যেন আপন মহিমায় আলো ছড়ায়। নিজের নিরপত্তা নিশ্চিত করে প্রতিবেশীদের প্রতিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বিপদ থেকে রক্ষার পাশাপাশি বিপদে ভয় না পেয়ে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে হবে। বড় ধরনের ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে তা বলা মুশকিল, তবে প্রস্তুতি থাকলে মোকাবিলা করতে সুবিধা হবে।
লেখক: নিবন্ধকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন