গত তিন দশকে মধ্যপ্রাচ্যে অন্তত ৬টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। প্রথম গাল্ফ ওয়ার, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াও ইয়েমেন যুদ্ধসহ প্রতিটি যুদ্ধই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ মদতে সংঘটিত হয়েছে। এর পাশাপাশি এ সময়ে ইসরাইলের জায়নবাদী সেনাবাহিনী বছরে কয়েকবার ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তু অধ্যুষিত পশ্চিমতীর, গাজা, লেবাননসহ প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকায় বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়ে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ও ট্রাজিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এসব যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু এবং হাজার হাজার বাড়িঘর, স্থাপনা ধ্বংসস্তুপে পরিনত হলেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী পশ্চিমারা যুদ্ধের শিকার হওয়া কোটি কোটি মানুষের মানবাধিকার রক্ষা কিংবা পুনর্গঠনের কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসেনি। তবে যুদ্ধের পেছনে দুই দশকে অন্তত ৮ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করতে তারা কুণ্ঠিত হয়নি। এখন ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনে শত শত কোটি ডলার খরচ করা হচ্ছে। মূলত বিশ্বকে অনিরাপদ প্রতিপন্ন করে অস্ত্র বাণিজ্য চাঙ্গা রাখার মধ্য দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের শত শত কোটি মানুষের রাজস্বের টাকা যুদ্ধের নামে হাতিয়ে নিয়ে বিশ্বকে অর্থনৈতিকভাবে আরো ভারসাম্যহীন করে তোলাই এ যুদ্ধের মূল লক্ষ্য। দুই দশকের বেশি সময় ধরে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি খরচ করে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল শক্তিগুলোর সাথেও কোনো যুদ্ধেই মার্কিনীরা বিজয়ী হতে পারেনি। বৃহৎ পরাশক্তি রাশিয়ার সাথে কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সমঝোতার পথে না গিয়ে শুধু অস্ত্র ও অর্থের বলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার চলমান প্রক্রিয়া থেকে বুঝা যাচ্ছে, যুদ্ধে জয়লাভ করা তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে একটি অন্তহীন যুদ্ধের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়ে তা প্রজ্জ্বলিত রাখা। বলাবাহুল্য, এই যুদ্ধের বাহ্যিক লক্ষ্য রাষ্ট্র দখল বা রিজিম পরিবর্তন নয়, চরম নিরাপত্তাহীনতার বলয় সৃষ্টি করে দেশে দেশে শত শত বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি ও নিরাপত্তা চুক্তির নামে বশ্যতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই নিরপেক্ষ নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে যুদ্ধের মূল লক্ষ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পর থেকে ইউক্রেন যুদ্ধের আগ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি, পশ্চিমাদের জ্বালানি নিরাপত্তাই ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মূল ফোকাল পয়েন্ট। এ ক্ষেত্রে ফান্ডামেন্টাল ইসলামিক সংস্কৃতি ও পলিটিক্যাল ইসলামকে টার্গেট করে তাদের প্রচারণা ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা সক্রিয় রাখা হয়েছে। ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরানের সাংস্কৃতিক তৎপরতার পাশাপাশি ইসরাইলী গোয়েন্দা ও সামরিক তৎপরতার সমান্তরালে আঞ্চলিক পক্ষগুলোর মধ্যে নিজেদের অবস্থান সংহত করার যথাসাধ্য প্রয়াসের ব্যতিক্রম ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ অর্ধশতাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় এ অঞ্চলে জায়নবাদীদের একতরফা তৎপরতা ক্রমেই মূল প্রভাবক হয়ে উঠেছে।
পরাশক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা বিশ্বের জন্য কি পরিনতি ডেকে আনতে পারে বিশ্ব এখন তা প্রত্যক্ষ করছে। স্লায়ুযুদ্ধোত্তর ইউনিপোলার বিশ্ব ক্রমেই ভারসাম্যহীন, উত্তপ্ত, নির্মম, অসহিষ্ণু এবং বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতার পর থেকেই ইউক্রেন হয়ে উঠেছিল রাশিয়াবিরোধী পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রকল্প। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের অনুরূপ রাশিয়া সীমান্তে ইউক্রেনকে একটি সামরিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা এবং ইউক্রেনে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাশিয়াবিরোধী শক্তিকে ক্ষমতায় রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানামুখী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাশিয়া বিভিন্ন সময়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছিল। গত দশকে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের মধ্য দিয়ে সে বার্তা স্পষ্ট হয়ে উঠলেও পশ্চিমাবিশ্ব রাশিয়ার নিরাপত্তার উদ্বেগকে পাত্তা না দিয়ে ইউক্রেনকে মিলিটারাইজ করার পায়তারার মধ্যেই ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেন অভিযানের নির্দেশ দেয়। ইউক্রেন অভিযানের শুরুতে রাশিয়া কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের ঘোষণা দিয়েছিল। প্রত্যাশা করা হয়েছিল, জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার বিনিময়ে রাশিয়ার সাথে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার পথ বের করতে সক্ষম হবে। ইতিমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ তার প্রথম বার্ষিকী পেরিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছে। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের পেছনে শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। নতুন বছরের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেনকে ভারী সমরাস্ত্র, অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক, যুদ্ধ বিমান, দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র দেয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুদ্ধকে আরো দীর্ঘায়িত করার ব্যবস্থা করছে। তবে মাঠের বাস্তবতা হচ্ছে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়ছে, নতুন নতুন শহরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে এবং ধ্বংসস্তুপের বিস্তৃতি বেড়ে চলেছে। এই যুদ্ধে রাশিয়ার পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। পশ্চিমারা আলোচনার মাধ্যমে কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সমাধানের পথকে অগ্রাহ্য করে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে অর্থনৈতিক-মানবিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়ে নতুন বিশ্বব্যবস্থা কায়েমের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। একদিকে পশ্চিমারা জেলনস্কি বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার প্রতিক্রিয়ায় চীন রাশিয়ার প্রতি সমর্থন পুর্নব্যক্ত করেছে। সেই সাথে রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘোষণা পুর্নব্যক্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এখন আক্ষরিক অর্থেই একটি ভয়াবহ পারমানবিক যুদ্ধের হুমকির মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছে। রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে পশ্চিমাদের কাঁদে বন্দুক রেখে কিয়েভের জায়নবাদী জেলনস্কি সরকার বিশ্বকে একটি পারমানবিক যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স, ইসরাইলের জায়নবাদী দুর্নীতিবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকার। রাশিয়ান ক্ষেপনাস্ত্রে যখন ইউক্রেনের বাখমুত, দোনেতস্ক, জাপরঝিয়া অঞ্চল থেকে ইউক্রেনের সৈন্যরা পালিয়ে যাচ্ছে, তখন ইসরাইলের রক্তপিপাসু সেনাবাহিনী পশ্চিমতীরসহ ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলে নতুন নতুন বসতি গড়ে তোলছে এবং নির্বিচার হামলা চালিয়ে প্রতিদিনই শিশুসহ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনীদের হত্যা করছে। এ বিষয়ে আরবরা এখনো নীরবতা ভাঙ্গেনি। ইরানের পারমানবিক অস্ত্রের জুজু এবং ইরানের উপর সম্ভাব্য সামরিক হামলার প্রস্তুতি ও ঘোষণা প্রচার করে এক ধরণের সন্ত্রস্ত অবস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি ইসরাইলের সাথে নর্মালাইজেশন বা সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আরব শেখদেরকে গোপণ আঁতাতে যোগ দিতে বাধ্য করছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে যুদ্ধ বিরতি নিশ্চিত করতে বেলারুশ সীমান্তে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হলেও পশ্চিমাদের সায় না থাকায় সে আলোচনা ফলদায়ক হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র ও লজিস্টিক সরবরাহ করতে শুরু করার আগেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পাশাপাশি তাকে কূটনৈতিকভাবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার এজেন্ডা সফল হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির একাট্টা মার্সেনারি সমর্থন সত্ত্বেও গত এক বছরে ইউক্রেনের উত্তরাংশের বিশাল এলাকা রাশিয়ান সেনাদের অগ্রযাত্রা ঠেকানো যায়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, রাশিয়ার সম্মতি থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের নেতারা যুদ্ধ বিরতি প্রশ্নে কোনো রাজনৈতিক-কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়নি। আন্তর্জাতিক মহলে দুইপক্ষে এক ধরণের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গড়ে ওঠার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোরালো ভূমিকা ছাড়া এই যুদ্ধের রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তৃতীয় কোনো পক্ষের এজেন্ডা অনুসারে, যুদ্ধের লক্ষ্য যদি হয় অস্ত্রের বাণিজ্য চাঙ্গা রাখা, তাহলে অবধারিতভাবেই এখানে ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরীয় যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। আফগানিস্তানে দুই দশক ধরে চলা যুদ্ধে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে তালেবানদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে, আফগান যুদ্ধে মার্কিনীদের এই পরিনতির আশঙ্কা অজানা ছিল কিনা? স্পষ্টতই বোঝা যায়, মহাদেশ-মহাসমুদ্র পেরিয়ে ভিন্নদেশে যুদ্ধব্যয়ের নামে মার্কিন জনগণের ট্যাক্স থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করে নিজেদের অর্থনীতিকে দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়ে বাইডেন প্রশাসন মূলত মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের অস্ত্র বাণিজ্য ও ওয়ার কন্ট্রাক্টরদের স্বার্থ হাসিল করছে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে শুরু করে জায়নবাদী ইহুদি প্রভাবিত পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়া, ব্যাংকিং সেক্টর, রাজনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ও পেন্টাগনের কুশীলবদের উপর নিয়ন্ত্রণ বরাবরই জায়নবাদী মোড়লদের হাতে। বিশ্বের আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলোর নেপথ্যে তাদের কলকাঠিই মূল ভূমিকা পালন করছে। ভৌগলিক অবস্থান, ধর্ম, ভাষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঐক্য ও মেলবন্ধনের হাজার বছরের অভিন্ন ইতিহাসের অংশীদার হয়েও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের সামগ্রিক স্বার্থ, নিরাপত্তা ও ফিলিস্তিনের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারার পেছনেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের জায়নবাদী কুশীলবরাই মূখ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। তাদের বলকানাইজেশন ও ডিস্ট্যাবিলাইজেশন প্রক্রিয়ার এজেন্ডা মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন থেকে এখন ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তৃতি ঘটানো হচ্ছে। ইসরাইলী জায়নবাদ ও ভারতের হিন্দুত্ববাদের মধ্যে গোপন গাঁটছড়া এখন অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ ও ইহুদি জায়নবাদীদের প্রধান প্রতিপক্ষ ও লক্ষ্যবস্তুও মুসলমানরা। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা ফিলিস্তিনের জমি দখল করে মধ্যপ্রাচ্যে একটি জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও গত ৭৫ বছরেও এটি রাজনৈতিকভাবে একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিনত হতে পারেনি। অন্যদিকে, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানসহ বিভিন্ন ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠায় কোনো একক রাষ্ট্রে বিশ্বের সর্বাধিক মুসলমানের বসবাস ভারতে। সেই ভারতকে এখন হিন্দুত্ববাদী জাতি রাষ্ট্রে পরিনত করে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নাগরিকে পরিনত করা চক্রান্ত করছে বিজেপি, বিএইচপি, সংঘপরিবার। একদিকে ফিলিস্তিনের মজলুম নাগরিকরা, অন্যদিকে ভারতের মুসলমানরা চরম নিপীড়ন-নির্মমতা ও নৃশংসতার শিকার হলেও পশ্চিমারা এ বিষয়ে শুধু নীরব দর্শকের ভূমিকা নয়, জায়নবাদিদের পক্ষাবলম্বন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক গণহত্যাবিরোধী মানবাধিকার সংগঠন জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ড. গ্রেগরি স্ট্যান্টন গত বছরের প্রথমদিকে ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে মুসলমান গণহত্যার প্রস্তুতির বিষয়ে বিশ্বকে সতর্ক করেছিলেন। ইতিপূর্বে বিগত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে হুতো ও তুতসিদের মুখোমুখী সহিংস রাজনৈতিক অবস্থান প্রত্যক্ষ করে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে গ্রেগরি স্ট্যান্টন লিখেছিলেন, আপনি যদি এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারেন, তাহলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে রুয়ান্ডায় বড় ধরনের গণহত্যা এড়ানো কঠিন হতে পারে। সে সতর্ক সঙ্কেত পাওয়ার পরও রুয়ান্ডা সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারায় ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত প্রধানত রুয়ান্ডান পেট্রিয়টিক ফ্রন্টের নেতা পল কাগামির নেতৃত্বাধীন হুতো মিলিশিয়াদের হাতে প্রায় ৮ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল উদার ও মধ্যপন্থী হুতোরা। জাতিগত রাজনৈতিক গণহত্যা সংঘটনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি স্ট্যান্টন ১০টি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে, ক্লাসিফিকেশন, সিম্বোলাইজেশন, ডিসক্রিমিনেশন, ডিহিউম্যানাইজেশন, অর্গানাইজেশন, পোলারাইজেশন, প্রিপারেশন, পারসিকিউশন, এক্সটারমিনেশন এবং ডিনায়াল। জম্মু-কাশ্মির থেকে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এর সবগুলো লক্ষণই বিদ্যমান আছে। মোদি সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইন, হিন্দুত্ববাদী সংঘপরিবারের প্রভাবশালী সদস্যদের মুসলিম বিদ্বেষী হেইট স্পিচ, নানা অজুহাতে মসজিদ, মুসলিম স্থাপত্যও পুরাকীর্তি ভাঙ্গা, গোরক্ষা আন্দোলন, গরুর গোশত খাওয়া অথবা ভিন্নমত পোষনের অপরাধে পিটিয়ে হত্যা করার অসংখ্য নজির রয়েছে। প্রায় ৭ বছর আগে ভারতের উত্তর প্রদেশের দাদরিতে গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে আখলাকুর রহমান নামের একজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল গোরক্ষকরা। আখলাকের যুবক ছেলেকেও পিটিয়ে আহত করেছিল তারা। সে ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর বিজেপির রাজনীতির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠলেও গোরক্ষকদের প্রতিহিংসা ও মুসলিম বিদ্বেষী নৃশংসতা বন্ধ হয়নি। মূলত মোদি সরকারের নীতিগত প্রত্যক্ষ সমর্থনে চলতি বছরের শুরু থেকে হিন্দুত্ববাদী নৃশংসতা বেড়ে চলেছে। রাজস্থানের বাসিন্দা জুনাইদ ও নারি নামের দুই যুবকের বিরুদ্ধে গরু পাচারের অভিযোগ তুলে গোরক্ষকরা দুজনকে একসাথে প্রাইভেটকারের মধ্যে পেট্টোল ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এরপর এই অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের রক্ষা করতে গোরক্ষক, বিএইচপি, বজরংদল, মহাসভাসহ কট্টরপন্থী হিন্দুরা সহিংস সভা-সমাবেশ করে পাল্টা হুমকি দিচ্ছে বলে পত্রিকায় সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় এ সপ্তাহে বিহারে গরু খাওয়ার অভিযোগ তুলে মোহাম্মদ খলিল আলমকে ধরে পিটিয়ে গায়ে পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার সংবাদ ছাপা হয়েছে। খলিল আলমকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের মুসলমান বিদ্বেষী নৃশংসতার দৃষ্টান্ত অনুসরণে বাংলাদেশের ভারতপন্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং রাজপথে একের পর এক এ ধরণের নৃসংশতার নজির সৃষ্টি করছে। আবুবকর, জুবায়ের, বিশ্বজিৎ, খাদিজা, আবরার ফাহাদসহ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে গত একযুগে অন্তত ৩০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির জেরে ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড ও অস্ত্রের ঝনঝনানি অতীতেও ঘটেছে। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় সংঘবদ্ধভাবে এমন পাশবিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ভারতসহ আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতিগত ও রাজনৈতিক সহিংসতা, আগ্রাসন ও গণহত্যার শিকার হচ্ছে মূলত ইসলামোফোবিক এজেন্ডার শিকার মুসলমানরা। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মাল্টিকালচারালিজমের স্বপক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্য গড়ে তুলতে না পারলে দেশে দেশে এই সহিংসতা গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যার পরিনতি ডেকে আনতে পারে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন