শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষা অর্জনের প্রধান মাধ্যম হলেও আজকাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর সেটা হচ্ছে কোচিং সেন্টার। এই কোচিং সেন্টারে ছাত্রছাত্রীরা টাকার বিনিময়ে শিক্ষা লাভ করে থাকে। আগে বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো পড়ার জন্য সীমিত পরিসরে কোচিং চালু থাকলেও, এখন তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। তখন স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরাই কেবল প্রাইভেট পড়াতেন। এর বাইরে তেমন কোনো কোচিং সেন্টার ছিল না। এখন স্কুল-কলেজের শিক্ষকের বাইরে অনেকেই কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত যুবক এখন কোচিং সেন্টার পরিচালনাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে।
এসব কোচিং সেন্টারে সকল বিষয়ে পড়ানো হয়। স্কুল-কলেজের বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীরা দল বেঁধে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়, সেখানে ক্লাস করে এবং পরীক্ষা পাশের প্রস্তুতি নেয়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যেমন কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন ক্লাসের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর শিক্ষা লাভের জন্যও প্রতিষ্ঠা হয়েছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টার। এসব কোচিং সেন্টারে সকল সাবজেক্টের ওপর কোচিং করানো হয়। নিজ নিজ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা কোচিং সেন্টারে সে সব বিষয়ে ক্লাস নিয়ে থাকে। এসব কোচিং সেন্টারের পরিচালকরা বেশ ভালো টাকা আয় করে থাকে। অনেকে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে বিপুল টাকার মালিক হয়েছে।
প্রকৌশল বিদ্যায় ডিগ্রি অর্জনকারী বহু প্রকৌশলী এখন প্রকৌশল সেক্টরে চাকরির পরিবর্তে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে এবং কোচিং করায়। আবার চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেও অনেকে এখন চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ না করে কোচিং করানোকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে এবং তারাও কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে এবং কোচিং করায়। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেও অনেকে চাকরি কিংবা ব্যবসার পরিবর্তে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে এবং কোচিং করায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব কোচিং সেন্টারে ক্লাস চলে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ সকল ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের জন্য এসব কোচিং সেন্টার কোচিং করায়। এক এক ক্লাসে ৪০/৫০ জন স্টুডেন্ট পর্যন্ত একসাথে ক্লাস করে। কোচিং সেন্টার আজ হয়ে উঠেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিকল্প পাঠশালা। স্কুল-কলেজে ক্লাস বাদ দিয়ে অনেক ছাত্রছাত্রী এখন নিয়মিতভাবে কোচিং সেন্টারে কোচিং করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে এসব কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে।
দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনের পোস্টার দেখা যায়। অনেক কোচিং সেন্টার আবার দেশব্যাপী তাদের শাখার মাধ্যমে কোচিং পরিচালনা করে। ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য গড়ে উঠেছে ক্যাডেট কোচিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন শেষে বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য গড়ে উঠেছে নানা ধরনের কোচিং সেন্টার। এক কথায় চারিদিকে এখন কেবল কোচিং সেন্টার আর কোচিং সেন্টার। কোচিং সেন্টারে কোচিং করাটা আজকে যেন শিক্ষা অর্জনে এগিয়ে যাবার পথ। আর কোচিং সেন্টারে কোচিং না করা মানে যেন শিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে পড়া। মোটকথা শিক্ষা ব্যবস্থাটা আজ কোচিং সেন্টার নির্ভর হয়ে পড়েছে, দিন দিন এর পরিধি বাড়ছে। ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে আজ কোচিং করে শর্টকার্ট পথে ভালো রেজাল্ট করতে চায়।
কোচিং সেন্টারনির্ভর এই শিক্ষা, একটি শিক্ষিত জাতি গঠনের অন্তরায় এবং শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। ছাত্রছাত্রীদের জানতে হবে, জ্ঞান বিজ্ঞানের যে কোনো শাখায় দক্ষ হতে হলে ঐ বিষয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়াশুনা করতে হবে এবং সাধনা করতে হবে। আগে এত কোচিং সেন্টার ছিল না এবং পড়াশোনা এত বেশি কোচিংনির্ভরও ছিল না। যুগে যুগে যেসব ব্যক্তি জ্ঞান বিজ্ঞানে সফলতা অর্জন করেছে এবং বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়ে আছে তারা কেউ কিন্তু এত বেশি কোচিং করেনি। তারা অধ্যয়ন করেছে এবং নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নই তাদের জ্ঞানের জগতে সম্রাট বানিয়েছে। বিজ্ঞান কিংবা সাহিত্য সবক্ষেত্রেই একথা সত্য। আইনস্টাইন, নিউটন, মেরি কুরি, গ্যালিলিও, পিথাগোরাস, আর্কিমিডিস, আলফ্রেড নোবেল, জেমস ওয়াট, মাইকেল ফ্যারাডে, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, গ্রেগার মেন্ডাল, জগদিশ চন্দ্র বসু, এপিজে আবুল কালামসহ বিশ্ববিখ্যাত সকল বিজ্ঞানী নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা এবং গবেষণার মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করেছে। একইভাবে শেক্সপিয়ার, জন মিল্টন, দান্তে, হোমার, টি এস এলিয়ট, লিও টলস্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, মার্ক টুইন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আল্লামা ইকবাল, জালালউদ্দিন রুমি, মির্জা গালিব, ওমর খৈয়ামসহ বিশ্ব বিখ্যাত সকল কবি সাহিত্যিকও নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা এবং গবেষণার মাধ্যমেই সফলতা অর্জন করেছে।
তাই ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলবো, তোমরা কোচিংয়ের পিছনে বেশি সময় ব্যয় না করে সেই সময়টুকু পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নের পিছনে ব্যয় কর। তোমরা পাঠ্য বই বার বার অধ্যয়ন কর। কোনো বিষয় না বুঝলে বা বুঝতে কষ্ট হলে তোমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঐ বিষয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে তা বুঝে নাও। এভাবে পড়লে সকল বিষয় তোমার বুঝতে সুবিধা হবে এবং এক পর্যায়ে তা বুঝা হয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত, নিয়মিত পড়াশোনা, পাঠ্যপুস্তকের খুটিনাটি অধ্যয়ন তোমাদের সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং তোমরা অবশ্যই সফল হবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন