তিস্তা ব্যারেজের উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে ভারত সরকার তিস্তার পানি প্রবাহ অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে ফাল্গুন মাসেই তিস্তা নদী শুকিয়ে গেছে। এক সময়ের প্রমত্তা তিস্তা হেঁটে পার হওয়া যায়। তিস্তার যখন হাঁটু পানি, তখন এই হাঁটু পানি সরিয়ে নিতে নতুন ফাঁদ পাতছে ভারত সরকার।
তিস্তার পানি সরিয়ে নিতে গজলডোবা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের সেচ বিভাগ তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের অধীনে আরো দুটি খাল খননের কাজ শুরু করতে চলেছে। এর জন্য প্রায় এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই পদক্ষেপ জলপাইগুঁড়ি ও কোচবিহার জেলায় আরও বেশি জমিকে সেচের আওতায় আনতে সাহায্য করবে। কিন্তু বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে তিস্তার পানি প্রবাহ। এখন তিস্তায় যে পানিটুকু আসছে পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে আরো দুটি খাল খনন করা হলে তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ তলানিতে নেমে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সরকারের উচিত এখনই এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানানো।
বাংলাদেশ-ভারত তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। এক যুগের বেশি সময় ধরে তিস্তা চুক্তি ঝুলে রয়েছে। অথচ বন্যা ও শুষ্ক মৌসুমে তিস্তাপাড়ের মানুষ নানা সঙ্কটে পড়ে। তিস্তার সঙ্গে বাংলাদেশের ২৫টি নদীর সম্পর্ক রয়েছে। তিস্তা প্রকল্পের আওতায় নদীটি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে আরও ১০ মিটার গভীর হবে, দুইপাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার বাঁধ দেয়া যাবে। ফলে বন্যা প্রতিরোধ করে দুই পাড়ের ফসল ও ঘরবাড়ি রক্ষা পাবে। বিষয়টি তিস্তাপাড়ের মানুষজনও ভাবছে, তিস্তা নদী হলো এলাকার জীবন রেখা। তাই পানি চুক্তি না হওয়ায় এই মহাপ্রকল্পটি তিস্তাপাড়কে রাঙ্গিয়ে তুলবে। সে কারণে তিস্তা মহাপরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করছেন পানি বিশেষজ্ঞরা।
গত শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ি জেলা প্রশাসন রাজ্যটির সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিকের উপস্থিতিতে প্রায় এক হাজার একর জমি সেচ দপ্তরকে হস্তান্তর করেছে। এই জমি তিস্তার বাম তীরে দুটি খাল তৈরি করতে প্রশাসনকে সহায়তা করবে। অপরদিকে তিস্তা ছাড়াও জলপাইগুঁড়ি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলঢাকা নদীর পানিও সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য খালের দিকে সরানো হবে। মমতার সরকারের এই খাল খননের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ রুষ্ট হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় পর মমতার সরকারের খাল খননের সিদ্ধান্তে সমস্যায় পড়বে ঢাকা। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের ক্ষমতায় বসার পর তার আপত্তির কারণেই নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে তৈরি সঙ্কটের সমাধান হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, শিলিগুঁড়ির উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের একজন ফ্যাকাল্টি বলেছেন, তিস্তা থেকে আরও বেশি পানি নতুন খালের মাধ্যমে প্রবাহিত হলে উষ্ণ মৌসুমে আরও কম পরিমাণে পানি যাবে বাংলাদেশে। মূলত, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে তিস্তায় প্রায় ১০০ কিউমেক (সেকেন্ডে প্রতি কিউবিক মিটার) পানি পাওয়া যায়। যেখানে ভারত এবং বাংলাদেশে কৃষি জমিতে সেচের জন্য প্রয়োজন প্রায় ১৬০০ কিউমেক পানি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই উদ্যোগে পানি নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা বাড়বে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ভারতের সেচ দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প অনুসারে, তিস্তা এবং জলঢাকা থেকে পানি তোলার জন্য কোচবিহার জেলার চ্যাংরাবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন করা হবে। অপর খালটির দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার। যেটি তিস্তার বাম তীরে নির্মিত হবে। খাল দুটি খনন হলে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় এক লাখ কৃষক সেচের সুবিধা পাবে। তিস্তা ব্যারেজ জলপাইগুড়ি জেলার গাজলডোবায় অবস্থিত। উত্তরবঙ্গের ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ কাজের সুবিধার জন্য ১৯৭৫ সালে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি চালু হয়েছিল। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, তিস্তা নদীর পানি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রবাহমান অন্য নদী পানিও যাতে খালের মধ্য দিয়ে দুইপারে চাষ অঞ্চলে সেচের মাধ্যমে পাঠানো। ১৯৭৫ সালে উত্তরবঙ্গের ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ সুবিধার উদ্দেশ্য নিয়ে চালু করা হয়েছিল তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প। পরিকল্পনা ছিল তিস্তা নদীর দুই পাড়ের কৃষি জমিতে খালের মাধ্যমে সেচের পানি সরবরাহ। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্যান্য নদীর পানিও খালগুলোতে প্রবাহিত করা। যদিও প্রকল্পটি কয়েক দশক ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেবল ১ দশমিক ৪ লাখ হেক্টর জমিতে বর্তমানে পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। নতুন করে দুটি খাল খননের বিষয়ে গতকাল শনিবার পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক বলেন, জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসন খাল খননের জন্য আমাদের এক হাজার একর জায়গা হস্তান্তর করেছে। ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এটিকে একটি জাতীয় প্রকল্প হিসাবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেনি। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারে তহবিল না পেলেও, পর্যায়ক্রমে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার চেষ্টা করব। জলপাইগুড়ি জেলার ধুপগুড়ি ব্লকের আরেকটি খাল মেরামত করবে সেচ বিভাগ। এ খালটি চালু হয়ে গেলে ব্লকের ৩২ হাজার একর জমিতে সেচ সুবিধা পাবে কৃষকরা।
অপরদিকে, বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, তিস্তানির্ভর অঞ্চলে ব্যাপক অকাল ও হড়কা বন্যার সৃষ্টি করে আসছে। অসময়ে অতিবৃষ্টি এবং শুকনো মৌসুমে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার ফলে কয়েক বছর ধরে তিস্তা অববাহিকায় খরা, অকাল বন্যার মাত্রা, ব্যাপকতা এবং স্থায়িত্বকালও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে তিস্তা নদী নিয়ে চিনের মহাপ্রকল্প থমকে রয়েছে। প্রশাসনের দিল্লিঘেঁষা কিছু আমলার কারণে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও তিস্তা প্রকল্পের কাজ লালফিতায় আটকে রয়েছে।
এদিকে ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় মহাপরিকল্পনার বিষয়টি উঠে আসে। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ২৭টি প্রকল্পের চুক্তি হয়েছিল। তার মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনার প্রকল্পও ছিল। তারই আলোকে চীন সরকার নিজ উদ্যোগ ও খরচে ২ বছর ধরে তিস্তার ওপর সমীক্ষা চালিয়ে একটি প্রকল্প নির্মাণ সম্ভব বলে বাংলাশেকে প্রস্তাব দেয়। চিনের রাষ্ট্রদূত তিস্তা নদী এলাকা পরিদর্শন করে আসেন। তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে গত কয়েক বছরে বেশকিছু মানববন্ধন, সভা, সেমিনার হয়েছে। পানি চুক্তি না হওয়ার কারণে এ সব মানববন্ধন ও সেমিনার থেকে তিস্তা মহাপরিবল্পনা বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন