মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় গত বুধবার বুয়েটের ছাত্র গওহর তপু ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারায়। বিষয়টি যেন পথচারীদের মনে দাগ কাটতে পারেনি। কি রেললাইন, কি সড়কপথ কোথাও পথচারীদের সতর্ক হতে দেখা যায় না। যে যেভাবে পারছে বেপরোয়াভাবে মোবাইলে কথা বা ইয়ারফোনে গান শুনতে শুনতে চলাচল করছে। গতকাল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার তপুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর মগবাজার-ওয়ারলেস রেলগেট, যেখানে তার মৃত্যু হয়েছিল, এলাকার একটি অসাধারণ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনসংশ্লিষ্ট চিত্রে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ অবাধ ও অসচেতনভাবেই রেললাইনের ওপর দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। একদিন আগে যে এখানেই ট্রেনের ধাক্কায় তপুর মৃত্যু হয়েছে, এ কথা তারা একেবারে ভুলে গেছে। রেল কর্তৃপক্ষও পথচারীদের সতর্ক করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অথচ এসব রেলগেটে রেলের লোক রয়েছে এবং ট্রাফিক সিগন্যালও থাকে। ইচ্ছা করলে রেল কর্তৃপক্ষ রেল চলাচলের সময়টুকুতে পথচারীদের সতর্ক করার উদ্যোগ নিতে পারে। এমনকি রেললাইনের ১১ ফুটের মধ্যে কোনো লোকজনের থাকা নিষিদ্ধ করার আইনটি অন্তত শহরাঞ্চলের রেললাইন এলাকায় কার্যকর করতে পারে। আইন থাকার পরও তা বাস্তবায়ন না করার দায় রেল কর্তৃপক্ষ কি এড়াতে পারে?
যে কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আহত হওয়া নিয়ে আমরা শোকাভিভূত হই। এ নিয়ে আলোচনাও হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে ঘোষণা দেয়। কিছুদিন না যেতেই সব ভুলে আগের চিত্রের অবতারণা হয়। বছরের পর বছর ধরে, এটা চলে আসছে। আরেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটা না পর্যন্ত এ নিয়ে আর মাথা ঘামানো হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও পথচারী কেউই সচেতন হয় না। এর ফলে একের পর এক দুঃখজনক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। রেললাইন ধরে হাঁটা ও সড়কপথে যত্রতত্রভাবে পারাপার হওয়া যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। এর সাথে নতুন যুক্ত হয়েছে মোবাইল বা ইয়ারফোন। মোবাইল বা ইয়ারফোনে কথা বলা ও গান শুনতে শুনতে রাস্তা পারাপারের দৃশ্য মামুলি হয়ে পড়েছে। শুধু পথচারী নয়, গাড়িচালকদেরও মোবাইলে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। এর ফলে প্রায়ই ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা ২০১০ সালে চট্টগ্রাম মিরশরাই ট্র্যাজেডির কথা মনে করতে পারি। গাড়িচালকের মোবাইলে কথা বলার সময় বেখেয়াল হয়ে পড়ায় এ মর্মবিদারী দুর্ঘটনা ঘটে এবং বহু স্কুলছাত্র নিহত হয়। এ ধরনের দুর্ঘটনা পরবর্তীকালে আরও ঘটেছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও এ চিত্রের পরিবর্তন হয়নি। সময় গড়ানোর সাথে সাথে সবকিছুই বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে। পথচারীদের মধ্যেও কোনো বোধের উদয় হয় না। তারা মোবাইল বা ইয়ারফোন কানে লাগিয়েই ব্যস্ততম ও বিপজ্জনক স্থান দিয়ে পার হচ্ছে। মনোবিশ্লেষকরা বলছেন, মোবাইল বা ইয়ারফোন যখন কানে থাকে, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মনোযোগ সেদিকেই থাকে। তার আশপাশের চিত্র অনেকটা উহ্য হয়ে যায়। তার সচেতনতা অনেকাংশে কমে যায়। এর ফলে রাস্তা পার হওয়ার সময় কোনো কিছু খেয়াল থাকে না। এমনকি গাড়ি হর্ন দিলেও তা কানে পৌঁছায় না। ফলে সচেতন চালক গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বেপরোয়া চালকের গাড়ির নিচে অবধারিতভাবেই পথচারীদের চাপা পড়তে হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সড়ক বা রেলপথ পারাপারে এখন আর নির্দিষ্ট কোনো স্থানও দেখা যায় না। যে যেভাবে পারে পার হয়ে যায়। উন্নত বিশ্বে এটা কল্পনাও করা যায় না। সেখানে পথচারীদের জন্য রাস্তা পারাপারের নির্দিষ্ট স্থান ও সিগন্যাল রয়েছে, সেগুলো পথচারীরা যেমন মান্য করে, তেমনি গাড়িচালকরাও মান্য করে। অমান্য করলেই ত্বরিত গতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমাদের এখানে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
সড়ক ও রেলপথ পার হতে গিয়ে পথচারীদের বেঘোরে প্রাণ হারানোর খবর এবং পথচারীদের অসচেতনভাবে চলাচলের চিত্র প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এতে জনসাধারণও সচেতন হচ্ছে না, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সচেতনতামূলক কোনো কার্যক্রম নিচ্ছে না। এই অসচেতনতার কারণে মূল্যবান অনেক প্রাণ অকালেই ঝরে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থান দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় পথচারীদের মধ্যে অনেক সময় এমন মনোভাব দেখা যায় যে, তাদের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন নেই, গাড়ি বা ট্রেন চালকদের সতর্ক হতে হবে। এই মনোভাবের কারণেই বেশিরভাগ পথচারী দুর্ঘটনার শিকার হয়। অথচ পথচারী এবং গাড়িচালক উভয়েরই সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমি সতর্ক হব না, অন্যকে সতর্ক হতে হবেÑএ মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মোবাইল বা ইয়ারফোন কানে দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার মতো অমার্জনীয় ভুল আর কিছুই হতে পারে না। পথচারীদের মনে রাখা দরকার, রাস্তা পার হওয়ার সময় মোবাইল বা ইয়ারফোনে কথা বলা ও গান শোনা কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ রাখলে কোনো ক্ষতিই হয় না, বরং দুর্ঘটনার হাত থেকে জীবনই বেঁচে যায়। কাজেই যত্রতত্রভাবে রাস্তা পার হওয়া এবং মোবাইল বা ইয়ারফোন কানে দিয়ে পথচলা বন্ধ করে নিজ জীবন বাঁচানোর দিকেই সকলকে নজর দিতে হবে। সড়ক ও রেল কর্তৃপক্ষকেও এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। রাস্তা পারাপারের নির্দিষ্ট স্থান ঠিক করে দেয়া থেকে শুরু করে সেসব স্থান দিয়ে পথচারীদের চলতে বাধ্য করার মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন