প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত সদস্যদের সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, কোনোভাবেই সশস্ত্রবাহিনীর সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেয়া যাবে না। শান্তিরক্ষা মিশনে দেশের সুনাম সমুন্নত রাখতে হবে। তিনি এই মর্মে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন যে, বাংলাদেশ হচ্ছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ হয়, এমন কোনো অনাকাক্সিক্ষত কর্মকা- আমরা বরদাশত করবো না। প্রধানমন্ত্রীর এই গোটা বক্তব্যে জাতীয় আকাক্সক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে। এ কথা ওয়াকিবহাল মহলের কারো অজানা নেই, বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা ১৯৮৮ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিপুল সুখ্যাতি, সুনাম ও অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ২০ হাজার সদস্য ৪০টি দেশে ৫৪টি মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। সংঘাত-বিক্ষুব্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা ও অবদান ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়েছে। শুধু শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠাই নয়, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার ও জনকল্যাণেও তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এই সবকিছুরই জন্য যথাযোগ্য প্রশংসা ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে। তারা তাদের কর্মের দ্বারা, সততা ও আন্তরিকতার দ্বারা, সেবার দ্বারা নিজেদেরই প্রশংসা ধন্য করেননি, একই সঙ্গে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কেবল প্রধানমন্ত্রী নন, দেশের তাবৎ মানুষই চায় শান্তিরক্ষা মিশনে এখন কর্মরত সদস্যরাও পূর্বসূরীদের সুনাম-সুখ্যাতি অক্ষুণœ রাখবেন। দায়িত্বহীনতা, অসততা ও নৈতিক স্খলন দ্বারা তাদের, সশস্ত্রবাহিনীর ও দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করবেন না। এ ধরনের কিছু হলে তা বরদাশতযোগ্য হবে না।
স্মরণ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত কয়েকটি দেশের সদস্যদের বিরুদ্ধে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও ওই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকারী বিভিন্ন দেশের সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনসহ নানা অনাচার ও অপরাধের অভিযোগ উঠলেও বাংলাদেশ ছিল উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম, যার সদস্যদের বিরুদ্ধে কখনই এ ধরনের কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। এবার এহেন অভিযোগ কেন উঠলো, সেটা একটি বড় প্রশ্ন এবং তা অত্যন্ত দুঃখজনক। দুর্গত ও বিপন্ন মানবতার সেবায় নিয়োজিতদের এ রকম অপকর্ম কোনো বিবেচনাতেই বরদাশতযোগ্য হতে পারে না। অভিযোগ পাওয়ার পরই আইএসপিআর থেকে বলা হয়েছিল, বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পরের খবর আমাদের জানা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য বক্তব্য ও সতর্কবাণী থেকে মনে হয়, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়া হয়েছে। বলা আবশ্যক, যাদের শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানো হয়, তাদের মাধ্যমে সশস্ত্রবাহিনী ও দেশের ভাবমর্যাদা বাড়বে এমনটাই আশা করা হয়, ব্যতিক্রম হবে কেউ কল্পনা করে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের নৈতিক মানবৃদ্ধি ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে কি কোনো প্রকার ব্যত্যয় ঘটছে? বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা শুরু থেকেই উচ্চ নৈতিক মানসম্পন্ন। এখন তাদের কারো কারো মধ্যে নৈতিকতার অধঃপতন পরিলক্ষিত হচ্ছে কেন? শুধু জাতিসংঘ শান্তি মিশনে নয়, দেশের অভ্যন্তরেও সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অপরাধমূলক কর্মকা- ও নৈতিক স্খলনজনিত অপকর্মের অভিযোগ শ্রুত হয়। সবারই জানা, এলিট ফোর্স র্যাবে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। র্যাবের সুনাম-দুর্নাম দুই আছে। এই সুনাম-দুর্নামের ভাগিদার সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরাও হচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের মামলায় র্যাব কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয় কারো অজানা নেই। হত্যাকা-ের জন্য যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের কয়েকজন সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের একাংশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি বা অপরাধে অংশ নেয়ার অভিযোগ এখন আর কোনো নতুন বিষয় নয়। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের কারো কারো বিরুদ্ধেও যদি এসব অভিযোগ ওঠে, তাহলে দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না।
সশস্ত্রবাহিনী দেশের গৌরব ও অহংকার। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যম গড়ে ওঠা এই বাহিনীর প্রতি মানুষের অপরিমেয় শ্রদ্ধা, আস্থা ও ভালোবাসা রয়েছে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী এই বাহিনী জাতীয় দুর্যোগ-বিপর্যয়েও মানুষের আশা-ভরসার প্রধান নির্ভরযোগ্য স্থল। সেই বাহিনীর সদস্যদের কারো কারো নৈতিক মান নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে তবে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। গত কয়েক বছর, ধরে এ ধরনের প্রশ্ন উঠছে কেন, সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। মূল দায়িত্বের বাইরে বিভিন্ন দায়িত্বে বিশেষত অর্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়োজিত করা ঠিক হচ্ছে কিনা সেটাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। বলার অবকাশ রাখে না, সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের উচ্চ নৈতিক মান যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি সেবা ও ত্যাগের মনোভাবে তাদের উজ্জীবিত করে তুলতে হবে। আমরা আশা করবো, সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এদিকে আশু দৃষ্টি দেবে এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ-পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন