রফিকুল ইসলাম সেলিম : বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে গণপরিবহন সঙ্কটে যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। এই সঙ্কটকে পুঁজি করে গলাকাটা হারে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এতে করে স্বল্প আয়ের লোকজন বিশেষ করে কর্মজীবীরা মহাবিপাকে পড়েছেন। আয়ের বিরাট অংশ যাতায়াত খাতে রাস্তায় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে পথে পথে যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের মারামারি, হাতাহাতির ঘটনায় চরম বিশৃঙ্খলা চলছে।
জনসংখ্যার তুলনায় মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন রুটে পর্যাপ্ত যানবাহন নেই। রুট পারমিট নিয়েও রাস্তায় নেই অনেক বাস, মিনি-বাস, টেম্পু, হিউম্যান হলার। গণপরিবহনের বিরাট অংশ অচল হয়ে পড়ে আছে। আন্তঃজেলার বিভিন্ন রুটে চলাচলের অযোগ্য বাস, মিনিবাস চলছে মহানগরীর বিভিন্ন রুটে। বেশির ভাগ বাস, মিনিবাসের নেই ফিটনেস। ক্ষণে ক্ষণে রাস্তায় বিকল হচ্ছে এসব যানবাহন। পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, যানবাহনের মূল্য বেড়েছে, বেড়েছে যন্ত্রাংশের দামও। সরকারের নানা ট্যাক্স ও করের হারও বেড়েছে কয়েকগুণ। বিশ্ববাজারে দিনে দিনে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে তার উল্টো। চড়াদামের জ্বালানি দিয়ে অনেক পরিবহন মালিক খরচ পোষাতে পারছে না। এসব কারণে পরিবহন খাতে নতুন বিনিয়োগ নেই। রাস্তায় নতুন গাড়ি তেমন একটা নামছে না। জোড়াতালি দিয়ে লক্কড়-ঝক্কড় বাস, মিনিবাসে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। মহানগর ও জেলার কয়েকটি রুটে সরকারি সংস্থা বিআরটিসি’র কয়েকটি বাস নামানো হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ১২টি রুটে প্রায় দেড় হাজার বাসের রুটপারমিট থাকলেও এতসংখ্যক বাস রাস্তায় নেই। রুটপারমিট পাওয়া বাসের একটি বিরাট অংশ অচল হয়ে গেছে। এসব রুটে নতুন কিছু বাস নামানোর কথা থাকলেও তেমন একটা নামেনি। বিআরটিএ’র একজন কর্মকর্তা জানান, রুটপারমিট নিয়ে রাস্তায় বাস না নামানোর কারণে অনেকের রুটপারমিট বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে অনেককে রুটপারমিট দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন রুটপারমিট যারা পেয়েছেন তারাও এখন সব বাস নামাতে পারেননি। বাস, মিনিবাসের মতো নগরীর বিভিন্ন রুটে হিউম্যানহলার ও টেম্পুর সঙ্কট রয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর নিকটবর্তী উপজেলা সীতাকুন্ড, হাটহাজারী, বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারাসহ জেলার বিভিন্ন রুটেও পরিবহন সংকট রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে যানবাহন সংকট এখন চরমে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, পটিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার অর্ধশত রুটে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব এলাকা থেকে প্রতিদিনই কর্মজীবী ও চাকরিজীবীসহ হাজার হাজার মানুষ মহানগরীতে আসা-যাওয়া করে। পরিবহন স্বল্পতায় তাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।
উত্তর চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন রুটেও পরিবহন সংকট চলছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায় রুটে মিনিবাস স্বল্পতার কারণে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নগরীর নিউমার্কেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দুটি বিআরটিসি’র বাস পরিচালনার ঘোষণা দেন। তবে তা এখনও কার্যকর হয়নি। ওই বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া আদায়ের কথাও বলেছিলেন তিনি। মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস, মিনিবাসের বিরাট অংশ প্রতিদিন রিজার্ভ ভাড়ায় চলে যাচ্ছে। দেশের সর্ববৃহৎ ইপিজেড চট্টগ্রাম ইপিজেড, কর্ণফুলি ইপিজেড ছাড়াও কালুরঘাট ও সাগরিকা শিল্প এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার কাজে প্রতিদিন অসংখ্য বাস রিজার্ভ ভাড়ায় যাচ্ছে। এখন চলছে পর্যটন মৌসুম, এই অঞ্চলের প্রতিটি পর্যটন স্পটে মানুষের ঢল। মহানগরীর অলিগলি আর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও পিকনিক পার্টি ছুটছে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। কলকারখানার শ্রমিক, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও যাচ্ছে পিকনিক ও শিক্ষা সফরে। তারা বাহন হিসেবে নিচ্ছে নগরী ও জেলার বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাস, মিনিবাস। বিয়ে-শাদি, রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও বাস, মিনিবাস রিজার্ভ করা হচ্ছে। ফলে রাস্তায় গণপরিবহন সঙ্কট এখন আরও চরমে উঠেছে।
গতকাল সরকারি ছুটির দিনেও রাস্তায় গণপরিবহনের অপেক্ষায় অসংখ্য মানুষের ভিড় দেখা যায়। তিন দিনের সরকারি ছুটির কারণে অনেকে সকালে গ্রামমুখী হয়েছেন। কিন্তু রাস্তায় নেমেই তাদের দুর্ভোগের মুখোমুখি হতে হয়। নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল ও কর্ণফুলি শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটের বাস, মিনিবাস ছেড়ে যায়। সকাল থেকে সেখানে যানবাহনের অপেক্ষায় শত শত মানুষকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থেকেও বাস না পেয়ে অনেকে ট্রাকে চেপে বসে গন্তব্য ছুটেছেন।
শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে তিনদিনের সরকারি ছুটি। দীর্ঘ ছুটি পেয়ে তাই চাকরিজীবীদের অনেকেই ঘুরতে যাচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায়। অনেকে পর্যটন শহর কক্সবাজার ও বান্দরবান যেতে বের হয়ে রাস্তায় গিয়ে বিপাকে পড়েন। কুতুবদিয়ার আল্লামা শাহ আবদুল মালেক শাহ আল-কুতুবির (র.) ১৬তম বার্ষিক ওরস ছিল গতকাল। কুতুবদিয়ামুখী মানুষের ভিড়ও ছিল বেশি। ওরশমুখী যাত্রীদের নিয়ে ওই রুটের অধিকাংশ গাড়িই রিজার্ভে চলাচল করছে। এর ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে যাওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে যাত্রীদের জন্য। এ রুটে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রীরা ছাড়াও দুর্ভোগে পড়েন ছুটির ফাঁকে ঘরে ফেরা মানুষ।
রাস্তায় কোনো গাড়ি আসতেই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন যাত্রীরা। বাস তো আছেই, ট্রাক-টেম্পু-ভ্যান-রিকশা-সবখানেই মানুষের ঠাসাঠাসি। কেউ গাড়ির ভেতর, কেউ কেউ ছাদে উঠে ঘরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতে পারলেও অধিকাংশই যেতে পারছেন না। আবার যাদের বাড়ি নগরীর আশপাশের উপজেলাগুলোতে তাদের অনেকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হেঁটেই রওনা দিচ্ছেন। মহানগরীর উত্তর প্রান্তের সিটি গেইট, অক্সিজেন মোড় ও মুরাদপুরেও ছিল একই চিত্র। ঘরমুখো মানুষের ভিড়, কিন্তু রাস্তায় গাড়ি নেই। পরিবহন সংকট আর যাত্রীদের দুর্ভোগের সুযোগে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করছেন গাড়ির চালক ও সহকারীরা। দক্ষিণ চট্টগ্রামে যাওয়ার সব গাড়িতেই ভাড়া দ্বিগুণের চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে বলে যাত্রীরা অভিযোগ করেন।
মহানগরী থেকে জেলার বিভিন্ন রুটে পরিবহন সংকটকে পুঁজি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে পরিবহন চালক ও শ্রমিকেরা। যাত্রীদের চাপ দেখলে পরিবহন চালকেরা ভাড়া কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে সকালে অফিস শুরু সময়ে ২০ টাকার ভাড়া ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। পটিয়া এলাকার যাত্রীরা জানান, পরিবহন সংকটের কারণে পটিয়া থেকে মহানগরীমুখী প্রায় সব বাস, মিনিবাস যাত্রী প্রতি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। যাত্রীরাও যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে বিনাবাক্য ব্যয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে বাসে উঠে পড়ছে। এ চিত্র এখন সেখানে নিত্যদিনের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন