গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর ফের দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় দুর্বৃত্তরা মোটরসাইকেলে এসে তার ঘরে ঢুকে খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে তিনি মারা যান। হত্যাকারী দুর্বৃত্তদের পরিচয় জানা যায়নি। কোনো তরফে হত্যার দায় স্বীকার করতেও দেখা যায়নি। খুনিদের গ্রেফতারে পুলিশ জোর তৎপরতা শুরু করেছে। এ পর্যন্ত অন্তত ১৮ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি মহল থেকে সরকারবিরোধীদের ওপর দোষ চাপানোর একটা প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সন্দেহের আঙুল তুলেছে উগ্রবাদী বা জামায়াত-শিবিরের প্রতি। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া এ পর্যন্ত যাদের সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগ জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। কারো নাম না উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তিকে এই কৃত অপরাধের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়, এটা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাপুরুষোচিত কাজ। আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবীর নানক প্রমুখের বক্তব্যও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, তদন্তের আগেই হত্যাকারী কারা তা নির্দেশ করা বা কারো প্রতি সন্দেহ প্রকাশ সমীচীন নয়। তাতে হত্যাকারীরা পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। প্রকৃতই কোনো তথ্য যদি সরকারের কাছে থাকে তবে জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা উচিত। ব্লেম গেম মোটেই কাম্য হতে পারে না।
দোষারোপের রাজনীতি যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা বড় প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে আমরা বহু ঘটনার ক্ষেত্রে দেখেছি, ঘটনা ঘটার পরপরই সরকারি মহল থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর দোষ চাপানো হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধীদলের তরফেও পাল্টা সরকার বা সরকারি দলকে দায়ী করা হয়েছে। সম্প্রতি আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে। একজন মন্ত্রী শ্রমিকদের দাবি-দাওয়াকে ন্যায়সঙ্গত বলে অভিহিত করেছেন। প্রশ্ন হলো, শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া যদি ন্যায়সঙ্গত হয় এবং তারাই যদি বিক্ষোভ-সমাবেশ ও কর্মবিরতি করে থাকে, তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দায়ী করার কি কোনো হেতু থাকে? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বাড়িঘর ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনায় প্রথমে বিরোধীদলকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, বিরোধীদল নয়, এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়েছে হিন্দুরা। বিভিন্ন হত্যাকা- ও গুরুতর ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ব্লেম গেম প্রত্যক্ষ করা গেছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত ব্যাহত ও বিলম্বিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেছে। জজ মিয়া বানানোর সংস্কৃতি বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে হৃষ্টপুষ্ট করেছে। ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর’- রাজনীতিতে এ ধরনের প্রবণতা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনারই পরিচায়ক। রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। গণতন্ত্রহীনতার কারণে এই সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। তার স্থলে সন্দেহ, হিংসা, রেষারেষি হামলা, মামলা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের নৃশংস হত্যাকান্ডের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। এ ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে ব্যাপক হতাশা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। একজন সংসদ সদস্যেরই যদি নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা থাকে কি করে? কোনো মানুষের যে নিরাপত্তা নেই, এই হত্যাকান্ডের ঘটনা তারই প্রমাণ বহন করে। জানা গেছে, এ হত্যাকান্ডের পর সংসদ সদস্যদের মধ্যে মারাত্মক উদ্বেগ ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে তাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। এর আগেই সরকারের তরফে সংসদ সদস্য ও শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এ ঘটনার পর তা আরো জোরদার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আসলে এভাবে নিরাপত্তা জোরদার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। সবার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ঘাতক-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সে ব্যবস্থা নেয়ার প্রধান উপায় হলো, আইনের শাসন ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। ঘাতক-সন্ত্রাসী-অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের হাতে সোপর্দ করা। ব্লেম গেমে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি সম্ভব নয়। মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের হত্যাকারী যারাই হোক, আগে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য উপযুক্ত ও নিরপেক্ষ তদন্তের কোনো বিকল্প নেই। হত্যাকারী যারাই হোক, যে দল বা মতেরই হোক, তারা রেহাই পেতে পারে না। ঘাতক ঘাতকই, তার অন্য কোনো পরিচয় নেই। আমরা সঙ্গতকারণেই আশা করতে চাই, এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ব্লেম পরিহার করা হবে। ঘাতকদের গ্রেফতার এবং উপযুক্ত শাস্তিই এ ক্ষেত্রে প্রধান ও একমাত্র কর্তব্য। ব্লেম গেমের কারণে যদি ঘাতকরা পার পেয়ে যায় তাহলে এ ধরনের ঘটনা আগামীতে আরো ঘটতে পারে। আশঙ্কার এই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে সচেতন হতে হবে। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও তদন্ত সংস্থাগুলোকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাহলেই ঘাতকরা ধরা পড়বে এবং তাদের শাস্তি হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন