কমিউনিটি ক্লিনিক নামে পরিচিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের ১৪ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর চাকুরী ও কর্মসংস্থানে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও এসব কমিউনিটি ক্লিনিক ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট কমিউনিটি হেল্থ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) ভাগ্যে অনিশ্চয়তা ও হতাশা দেখা দিয়েছে। সকল নাগরিকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আমাদের সরকার এ দায়িত্ব পালনে অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে। সারাদেশে জেলা হাসপাতাল, উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কোথাও কোথাও ইউনিয়ন উপকেন্দ্র থাকলেও নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে এসব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারছে না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় সে গ্যাপ পূরণের লক্ষ্যেই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প গ্রহণ করেছিল সরকার। প্রথম দফায় ১৯৯৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষত, নারী ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছিল। ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলেও ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রকল্প পুনরায় চালু করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল হলেও এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রতিমাসে গ্রামীণ জনপদের ৮০ লক্ষাধিক মানুষ এই ক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবী করছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রমকে স্বাস্থ্যখাতে বর্তমান সরকারের সাফল্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি সরকারের সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পে কর্মরত সিএইচসিপিদের চাকুরী জাতীয়করণ এবং রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের আশ্বাসও দেয়া হয়েছে বলে সিএইচপি দাবী বাস্তবায়ন কমিটির প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা যখন সুনামের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে জরুরী স্বাস্থ্যসচেতনতা এবং গর্ভবতী মা ও শিশুদের টীকাদানসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনতে কার্যকর অবদান রাখছে, তখন এই প্রকল্পের অনিশ্চয়তা কাম্য নয়। যেখানে দেশের বড় বড় সরকারী হাসপাতালে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আছে। উচ্চ বেতনের ডিগ্রীধারী ডাক্তাররা হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের বদলে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাইয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বল্পবেতনের স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক কষ্ট করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় জরুরী স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতনতা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। আরো চারবছর আগেই চাকুরী জাতীয়করণের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস দেয়া হলেও বাস্তবে সিএইচসিপি’রা বঞ্চনার শিকার। ইতিমধ্যে হতাশ হয়ে শত শত সিএইচসিপি চাকুরী ছেড়ে দিয়েছেন বলেও খবর বেরিয়েছে।
প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত সিএইচসিপি’রা দীর্ঘদিন ধরেই অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সরকারী আশ্বাস মোতাবেক নিজেদের দাবী দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে সাড়ে ১৩ হাজার সিএইচসিপি নানা ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কথাও শোনা গেছে। অতীতে সরকার পরিবর্তনের পর কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে, ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তিত হলেও যা’তে কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ না হয়ে যায় সে লক্ষ্যে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য বছরে মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয় বলে জানা যায়। সেই সাথে এই প্রকল্পে জনবলও খুবই কম। সরকারী বরাদ্দের পাশাপাশি সারাদেশে স্থানীয় জনগণ কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য ৮০০ একরের বেশী জমি দান করেছেন বলেও জানা যায়। কয়েকটি ওষুধ কোম্পানী কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ দিচ্ছেন। অর্থাৎ স্বল্প ব্যয়ের এই প্রকল্পের সাথে একদিকে যেমন গ্রামীণ জনপদের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের জরুরী স্বাস্থ্যসেবার স্বার্থ জড়িত, সেই সাথে এ প্রকল্পে কর্মরত ১৪ হাজার সিএইচসিপি’র কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থ রয়েছে। যেখানের শত শত মানুষ ইতিমধ্যে ৮০০ একর জমি এই ক্লিনিকের জন্য দান করেছেন, সেখানে সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকলে একে একটি স্থায়ী এবং আরো সম্প্রসারিত দাতব্য উদ্যোগ হিসেবে এগিয়ে নেয়া অসম্ভব নয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ যেন সংশ্লিষ্টরা চুরি করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিতে না পারে সে বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করে এই প্রকল্পের সাথে জড়িতদের চাকুরীর অনিশ্চয়তা দূর করার পাশাপাশি জাতীয়করণের উদ্যোগও গ্রহণ করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন