গত রোববার সকালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাইভেটকারের পাঁচ আরোহী নিহত হয়েছেন। কালিয়াকৈর পৌরসভার গোয়ালবাথন এলাকায় ঢাকা থেকে কলিকাতাগামী মৈত্রী ট্রেনের ধাক্কায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিহতদের লাশ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে। দুর্ঘটনায় মৈত্রী ট্রেনের দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে ঢাকা-রাজশাহী ট্রেন চলাচল ৫ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সন্তান নিয়ে প্রাইভেটকারে স্কুলে যাবার পথে গোয়ালবাথন রেলক্রসিংয়ে পৌঁছলে ঢাকা থেকে কলিকাতাগামী মৈত্রী ট্রেনে ধাক্কা লাগে। এতে প্রাইভেটকারটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই রেলক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান ছিল না। কার্যত থাকারও কথা নয় কারণ সেখানে একটি সাবধানবাণীতে বলা আছে, ‘এই লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নাই। নিজ দায়িত্বে সাবধানে এই লেভেলক্রসিং পারাপার হইবেন।’ স্থানীয়দের অভিযোগ গতবছর একইস্থানে দাদা-নাতি ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হন। অবৈধ এই লেভেলক্রসিংয়ে প্রায়ই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশে অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের জন্য দুর্ঘটনার সংখ্যা দিনদিনই বাড়ছে। ব্যাপারটি অনেকটা নৈমিত্যিক ঘটনাতেও পরিণত হয়েছে। দেশে রেলেক্রসিংগুলো অনেকটা মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে রেলওয়ে নেটওয়ার্কে মোট ২ হাজার ৫৪১টি লেভেলক্রসিং আছে। এরমধ্যে অনুমোদিত ক্রসিংয়ের সংখ্যা মাত্র ৭৮০টি। বাকী ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। আবার ৭৮০টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রক্ষী বা গেইটকিপার রয়েছে। হিসেব অনুযায়ী ২ হাজার ২৯৯টি ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিং। এসব ক্রসিংয়েই প্রায়শ’ দুর্ঘটনা ঘটছে। শুধু রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টিরই কোন অনুমোদন নেই। রেল পুলিশের তথ্যমতে রেলপথে গত ৫ বছরে আড়াই শতাধিক ব্যক্তি ট্রেনে কাটা পড়ে কিংবা ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছে। এর বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে রেলক্রসিংয়ে। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে শুধু রেল ক্রসিং নয় বরং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে রেল লাইনও। বিভিন্নস্থানে রেললাইনের দু’পাশে গড়ে ওঠেছে অবৈধ মার্কেট। হাটবাজার, বড় বড় বস্তি। এছাড়াও অস্থায়ী ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট তো রয়েছেই। অস্বীকার করার উপায় নেই, রেলের সম্পত্তি অনেকাংশেই বেদখল হয়ে গেছে প্রভাবশালীদের খপ্পরে পড়ে। মাঝেমাঝে উদ্ধারের খবর বেরুলেও তা মূলত সাময়িক। অন্যদিকে রেলের উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের খবর পাওয়া যায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি রেলের প্রকৃত উন্নয়নের খবর নেই বললেই চলে বরং নানা ধরনের লুটপাটের খবরই প্রকাশিত হচ্ছে। আলোচ্যক্ষেত্রেও বলা যায় রেলক্রসিং সংরক্ষণ ও নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ইতোমধ্যে বহুবার বহুভাবে বলা হয়েছে। যতবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে ততবারই এর প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এই বাস্তবতা দুঃখজনক এবং অনাকাক্সিক্ষত।
এবারেও দুর্ঘটনার তদন্তে প্রথামাফিক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এধরনের অসংখ্য কমিটি এর আগেও করা হয়েছে। এসব কমিটির রিপোর্ট আদৌ প্রকাশিত হয় কিনা অথবা রিপোর্টকে আমলে নেয়া হয় কি-না তা বলা বা বোঝা মুশকিল। বলা বাহুল্য, রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। এর দায়ও নিচ্ছে না। এই অসতর্কতার দায় রেলবিভাগ কেবলমাত্র একটি সকর্তবাণী দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারে না। এখানে যেহেতু সড়ক রয়েছে সড়কবিভাগ বা স্থানীয় ট্রাফিক বিভাগও এর দায় এড়াতে পারে না। যেহেতু এটি একটি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা সেখানে গেটম্যান থাকলে এ ধরনের মর্মন্তুদ দুর্ঘটনা হয়তো ঘটত না। আমরা আশা করব, এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন