দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে বিএনপি তার ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার ঘোষিত কর্মসূচি পালন করেছে। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের বাধার কারণে বিএনপি তার কর্মসূচি পালনে সক্ষম হয়নি। আওয়ামী লীগ নির্বাধে তার কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপি ৫ জানুয়ারি সারাদেশে কালো পতাকা মিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ এবং ৭ জানুয়ারি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের কর্মসূচি দেয়। তার ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি রাজধানীসহ সারাদেশেই পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত ও ব্যাহত হয়। হামলা ও গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটে। আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারি উপলক্ষে ঢাকায় দু’টি পৃথক সমাবেশের ঘোষণা দেয়। ওই দু’টি সমাবেশ যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশের কারণে রাজধানীতে সৃষ্টি হয় ব্যাপক যানজট। বিএনপি ৭ তারিখের সমাবেশের জন্য প্রথমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও পরে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের জায়গা চায়। কোনো জায়গায়ই তাকে দেয়া হয়নি। উপরন্তু ৭ জানুয়ারি ভোর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ। পুলিশের অবস্থান ছিল মারমুখী। কাউকেই ওই দুই জায়গায় যেতে দেয়া হয়নি। কয়েকজনকে আটক করা হয়। নয়া পল্টনে পানি কামান, আর্মড কার, প্রিজন ভ্যানসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের সমাবেশ ঘটানো হয়। এর প্রতিবাদে বিএনপির তরফে রোববার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়। সে কর্মসূচিও পালন করতে দেয়া হয়নি। ব্যাপকভাবে বাধা প্রদান ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে।
ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের তরফে দাবি করা হয়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় অর্জিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এ দিনকে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে। প্রশ্ন হলো, এই কি গণতন্ত্রের নমুনা? এই কি গণতন্ত্রের বিজয়? ক্ষমতাসীন দল এ দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি পালন করবে, বিএনপিকে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হবে না, এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরা রাস্তায় পর্যন্ত নামতে পারবেন না, এটা কি ধরনের গণতন্ত্র? এক যাত্রায় পৃথক ফল, গণতন্ত্রের মূল্যবোধের সঙ্গে যায় না। বিএনপি তার গণতন্ত্র হত্যা দিবস উপলক্ষে কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা বলেন, ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে মাঠে নামতে দেয়া হবে না। বাস্তবেও সেটাই প্রত্যক্ষ করা গেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, এই কর্মসূচি পালনকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও সরকারি দলের লোকদের হামলায় সহস্্রাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন কয়েকশ’ নেতাকর্মী। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিরোধী দলকে কর্মসূচি পালন করতে না দেয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিরই খেলাপ নয়, সাংবিধানিক অধিকারেরও লংঘন। গণতন্ত্রে সভা-সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি স্বীকৃত। সব রাজনৈতিক দলই এসব কর্মসূচি পালনের অধিকার রাখে। সংবিধানেও এগুলো অধিকার হিসেবে গণ্য। কোনো দল, সংগঠন বা ব্যক্তিবর্গ শান্তিপূর্ণভাবে এসব কর্মসূচি পালন করতে পারে। তাতে বাধা দেয়ার এখতিয়ার সরকার বা কোনো দলের থাকতে পারে না। সরকারের কাছে যদি এমন তথ্য থাকে যে, কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আশঙ্কা আছে, তবে আগেই সেটা অবগত করানো অথবা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ৫ জানুয়ারিকেন্দ্রিক বিএনপির কর্মসূচি প্রসঙ্গে এমন কোনো শঙ্কা বা তার সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ সরকারের পক্ষ থেকে হাজির করা হয়নি। এরপরও কর্মসূচি পালন করতে না দেয়া, সমাবেশের অনুমতি না দেয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিএনপি বা বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। অথচ বিএনপি যখন ঘোষণা দিয়ে, অনুমতি চেয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছে তখন তাকে বাধা দেয়া হয়েছে এবং কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হয়নি। এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী এবং রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রকাশ।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন যে বিতর্কিত একটি নির্বাচন, ক্ষমতাসীন দলও তা স্বীকার করে। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র একটি বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদলের পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে গেছে। যে রাজনৈতিক সঙ্ককে দেশ পতিত হয়েছে, তার মূলে রয়েছে ওই নির্বাচন। এই রাজনৈতিক সঙ্কট মোচন ও গণতন্ত্রের চর্চা উন্মুক্ত করার তাগিদ যখন জোরালো, তখন বিএনপির কর্মসূচি পালনে বাধা দান কিংবা কর্মসূচি পালন করতে না দেয়া বিদ্যমান সঙ্কটকে আরো জটিল করে তুলতে পারে, রাজনীতিকে ফের সংঘাত-সহিংসতার পথে ধাবিত করতে পারে, যা কারো কাম্য হতে পারে না। একটি শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে সেটা হবে সঙ্কট উত্তরণে একটি বড় অগ্রগতি। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন কিছু বক্তব্য রেখেছেন, যাতে মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছে। তারা আশা করছে, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে, বৃত্তাবদ্ধ বা অবরুদ্ধ গণতন্ত্র মুক্তি লাভ করবে এবং শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। এই যখন গণপ্রত্যাশা তখন বিএনপির সঙ্গে এ ক’দিনে যা কিছু করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন