সময়টা এখন তথ্য প্রযুক্তির। বিশ্ব চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। এখন ঘরে বসে যেমনি সারা বিশ্বের খোঁজ-খবর রাখা যায়, ঠিক তেমনি ঘরটাও হতে পারে কর্মস্থল। সেটা সম্ভব ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং করে ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সেক্টরে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। তারপরেও রয়ে গেছে কিছু সমস্যা। এগুলোর সমাধান করা গেলে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় রেমিটেন্স আয়ের খাত। সৃষ্টি হতে পারে লাখ লাখ নতুন কর্মসংস্থান, যা দেশের বেকারত্বে সমস্যা সমাধানে বিরাট ভুমিকা রাখতে পারে। এজন্য ব্যক্তি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি উদ্যোগে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, এমনটাই মনে করছেন এই সেক্টরের ফ্রিল্যান্সার ও বিশিষ্টজনেরা। বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে তাদের কথাগুলো তুলে ধরছেন নুরুল ইসলাম।
ফ্রিল্যান্সিং একটি সম্ভাবনাময় খাত
মোস্তাফা জব্বার, সভাপতি, বেসিস
ফ্রিল্যান্সিং একটি সম্ভাবনাময় খাত। আমরা যদি এটাকে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে দেশের অর্থনীতিকে খুব ভালো অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শুধু ব্যক্তিগত উপর্জন দিয়ে খুব বড় কোনো কিছু করা যাবে না, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। তবে আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ফ্রিল্যান্সিং কাজ করতে তেমন কিছু জানার দরকার নেই। ২ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে কম্পিউটারে ইন্টারনেট নিয়ে বসলেই ফ্রিল্যান্সিং করা যাবে, ঝড় ঝড় করে টাকা আসতে শুরু করবে। এটা আমাদের একটি বড় সমস্যা।
বেকারত্ব দূরীকরণে ফ্রিল্যান্সিং ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে
মাহবুব জামান, সাবেক সভাপতি, বেসিস
বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং একটি বেশ বড় মার্কেট। বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণে এটা একটি ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে, এমনকি যেখানে ইন্টারনেট আছে, সেরকম উপজেলা পর্যায়েও অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সিং করছে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি কাঠামোগতভাবে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সারদেরকে আরো প্রশিক্ষণ ও যথার্থ তত্ত্বাবধায়ন করা দরকার। যাতে করে ফ্রিল্যান্সাররা মার্কেট প্লেসসহ বিভিন্ন জায়গায় ভালোভাবে কাজ করতে পারে।
খোঁজ-খবর নিয়ে প্রশিক্ষণ নিন
আল আমিন কবির, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটার
সবাই ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে একটা স্বপ্ন নিয়ে আসেন। তাদের স্বপ্নটা তখনই সত্যি হবে, যখন তারা সঠিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা উৎস থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করবে। ভুল জায়গায় গেলে, তাদের স্বপ্নটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। তাই যাদের কাছ থেকে অথবা যেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিবেন, তাদের সম্পর্কে ভালো মতো খোঁজ খবর নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারা যদি এই সেক্টরের মানুষ হন বা এই সেক্টর নিয়ে কাজ করেন, তাহলে গুগলে সার্চ করলে তাদের সম্পর্কে কিছু না কিছু তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়াও যারা দীর্ঘদিন এই সেক্টরে সফলতার সাথে কাজ করছেন তাদের পরামর্শ নিতে পারেন।
সঠিক বিষয় নির্বাচন করুন
নুরুদ্দিন আহমেদ হিমেল, ডিজিটাল মার্কেটার
আমরা শুধু ফ্রিল্যান্সারদের সফলতাই দেখি, কিন্তু এর পিছনে ব্যয়কৃত অক্লান্ত পরিশ্রম, সময় ও মেধা দেখি না। এতে অনেকে সিদ্ধান্তটা এভাবে নেন যে, অমুক ভাই বা বোন ওয়েব ডিজাইন-ডেভেলপমেন্ট করে মাসে দুই লাখ টাকা আয় করে, আমিও শিখবো। এটা ঠিক না। তার জন্য ওয়েব ডিজাইন-ডেভেলপমেন্ট সঠিক, আপনার জন্য সঠিক কিনা সেটা আগে বুঝতে হবে। না হলে ওই রকম সফলতার পরিবর্তে উল্টোটাও ঘটতে পারে। আপনার যেই কাজটি ভালো লাগে, আপনি সেই কাজটি নির্বাচন করুন। সঠিক বিষয় নির্বাচনের পর আপনাকে মেধা, শ্রম ও সময় দিয়ে ওই বিষয়ে দক্ষ হতে হবে। যদি দক্ষ হন, তবে মার্কেট প্লেসসহ সর্বত্র আপনার কাজের অভাব হবে না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে, সবাই হাতে গোনা কয়েকটি বিষয়ের প্রতি না ঝুঁকে, পছন্দানুযায়ী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করতে পারলে ব্যক্তি এবং দেশ উভয় লাভবান হবে।
অ্যাডসেন্সের নিয়ম মেনে কাজ করুন
পলাশ রহমান, আইটি উদ্যোক্তা
বাংলাদেশের অনেক ফ্রিল্যান্সারের আয়ের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে অ্যাডসেন্স। অনেকেই আছেন যারা না জেনে অথবা আয় বাড়ানোর জন্য নিয়ম না মেনে ওয়েবসাইট বা ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে থাকেন এবং স্প্যাম করে অল্প সময়ে অধিক আয়ের চিন্তা করেন। এতে সাময়িক লাভবান হলেও আজীবনের জন্য একাউন্টটি ব্যান্ড হতে পারে। এ ধরনের এক শ্রেণির লোভী ও অজ্ঞ লোকের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে আগের মত সহজে অ্যাডসেন্সের একাউন্ট করতে দিচ্ছে না। এই কার্যক্রম অব্যহত রাখলে দেশ থেকে অ্যাকাউন্ট করা বন্ধ করে দিতে পারে। সুতরাং নিয়ম মেনে কাজ করুন। নিজের এবং দেশের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকুন। আর যারা নতুন তাদের উচিত জেনে, বুঝে এবং সময় নিয়ে অ্যাডসেন্সের জন্য আবেদন করা।
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও গতি নিশ্চিত করতে হবে
এস এম মিশকাতুল ইসলাম, ফ্রিল্যান্সার ও আইটি উদ্যোক্তা
ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ইন্টারনেটের বিকল্প নেই। ঢাকাতে ইন্টারনেট আগের চেয়ে কিছুটা সহজলভ্য ও গতি সম্পন্ন হলেও ঢাকার বাইরে ইন্টারনেট সেবার মান আরো বাড়ানো প্রয়োজন। অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে এখনো ইন্টারনেটের দাম অনেক বেশি। তাছাড়া বিভাগীয় বা জেলা শহরে খুব বেশি আইএসপি প্রোভাইডার না থাকায়, দামের ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়। কোনো কোনো যায়গায় এক এমবিপিএস গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগের জন্য মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা করেও রাখা হয়। ফলে কারো যদি বেশি গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে তাদেরকে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়। এছাড়া যেসব এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ নেই, সেসব জায়াগায় টেলিকম অপারেটরের ইন্টারনেট ব্যবহার করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় থাকে না, যেটা অত্যন্ত ব্যয় বহুল এবং কম গতি সম্পন্ন, যা দিয়ে প্রফেশনাল কাজ করা খুবই কষ্টকর। সরকারের উচিৎ টেলিটকের থ্রিজি নেটওয়ার্ক সর্বত্র বিস্তৃত এবং সহজলভ্য করা এবং লোকাল পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম নির্ধারণে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা।
পরিশ্রম সততা ও গবেষণার বিকল্প নেই
নাফিউর রহমান, ইউটিউব মার্কেটার
আমাদের দেশের অনেক ইউটিউব মার্কেটার অজ্ঞতাবশত অথবা অতি লাভের আশায় কিছু ভুল করে থাকেন। যেমন কনটেন্টে পর্যাপ্ত ভ্যালু অ্যাড না করা, মানহীন ভিডিও আপলোড, ট্যাগ-ডেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় কিওয়ার্ডের ব্যবহার করা, অন্যের ভিডিও কপি করা, চ্যানেল ডেভলপ করার পিছনে যথেষ্ট সময় না দেওয়া, ভিউ বাড়ানোর জন্য টাইটেলে ভুল তথ্য দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় কমেন্টিং, ইচ্ছামত ইউটিউব অ্যাকাউন্ট খুলে অপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার, ইউটিউবে অ্যাডসেন্স নিয়ে ফেক ভিউ বা ফেক অ্যাড ক্লিক করা ইত্যাদি। এসব অপরাধের কারণে শুধু তার একটি চ্যানেল না বরং তার সাথে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত অন্যান্য ভালো চ্যানেলগুলোও সাসপেন্ডের সম্মুখীন হতে পারে। এমনকি দেশে থেকে ইউটিউবের মাধ্যমে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই ইউটিউবে কাজ করতে চাইলে নিয়মিত ভিউয়ার্সদের চাহিদানুযায়ী তথ্যবহুল এবং মান সম্পন্ন ভিডিও দিয়ে চ্যানেল সাজাতে হবে। এ জন্য পরিশ্রম, সততা এবং গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।
দ্রুত পেপাল চালু করা হোক
এ এইচ রিপন, বেসিসের আউটসোর্সিং পুরস্কারপ্রাপ্ত ফ্রিল্যান্সার
বর্তমানে বাংলাদেশে অনলাইন পেমেন্ট মেথড হিসেবে পেওনিয়ার, স্কিল, পেইজা, নেটেলার, জুম চালু আছে। এছাড়াও আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সাররা ওয়ার ট্রান্সফার সিস্টেমটি ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু উন্নত বিশ্বে অনলাইন অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় পেপাল। এটা যেমন অনলাইনের প্রায় সকল কাজে ব্যবহার করা যায়, তেমনি সাশ্রয়ীও। এই কারণে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের উপার্জিত অর্থ গ্রহণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থ প্রদানের জন্য পেমেন্ট মেথড নিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়, ব্যয় হয় অতিরিক্ত অর্থ। সরকারিভাবে ঘোষণা দেয়া হলেও, এখনো এটা চালু করা সম্ভব হয় নি। তাই এটা যত দ্রুত চালু করা যাবে ততই এই সেক্টরের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আর বর্তমানে আমারা যে পেমেন্ট মেথডগুলোর মাধ্যমে অর্থ লেন-দেন করি, অপ্রয়োজনে এগুলোতে একাধিক একাউন্ট খোলা বা নিয়মিত অর্থ লেনদেন না করলে এগুলোও তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে। তাই আমাদের উচিৎ এগুলোর সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন