সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে সব ধরনের আন্তর্জাতিক কনভেনশন লঙ্ঘন এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের আহ্বান উপেক্ষা করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারী বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের বর্বরতা চলছেই। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয় রোধে বিশ্বসম্প্রদায়ের কোন আহ্বান ও উদ্যোগই গ্রাহ্য করছে না মিয়ানমার সরকার। এমনকি খাদ্য সহায়তার মত মানবিক উদ্যোগকেও ঠেকিয়ে দিচ্ছে তারা। দরিদ্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য মালয়েশিয়ার প্রস্তাবিত একটি খাদ্য সামগ্রী বহনকারী জাহাজ মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করতে দেবেনা বলে জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার। উপরন্তু মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকার কিছুটা লোক দেখানো ও দায়সারা ভূমিকা নিয়ে রোহিঙ্গা নির্যাতন বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের পর সেই তদন্ত রিপোর্টে সেখানে কোন হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়নি মর্মে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা’ বিশ্বসম্প্রদায়কে আরো হতবাক করেছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে গত বছরের মাঝামাঝিতে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে শুরু থেকেই সেখানকার বৌদ্ধ সম্প্রদায় শুধু অসহযোগিতাই করছেনা, রোহিঙ্গাদের মত এই কমিউনিটির বিরুদ্ধেও তারা সহিংস তৎপরতা চালিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের নির্মম সহিংসতার বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তায় এসব ঘৃণ্য কর্মকান্ডে সূচি সরকারের সমর্থনই প্রকাশ পায়। তবে আশার কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের দায়সারা ভূমিকা নিয়ে কিছুটা উষ্মা থাকলেও মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি মুসলিম দেশের সক্রিয় প্রচেষ্টায় এবার ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) বিশেষ অধিবেশনে বসছে। ইতিপূর্বে আসিয়ানের পক্ষ থেকেও মিয়ানমারের প্রতি সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়েছিল।
বিশেষত, মালয়েশিয়ার শক্ত অবস্থানের কারণেই আগামী ১৯ জানুয়ারী রাখাইন মুসলমান ইস্যুতে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ইতিপূর্বে জেনেভা ও ব্রাসেলসে দফায় দফায় বৈঠক করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারকে কার্যকর কিছু করার তাগিদ দেয়া হলেও নেপিদো’র পক্ষ থেকে কোন ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় মালয়েশিয়া থেকে ওআইসি একটি শক্ত অবস্থান নিতে যাচ্ছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সেখানে হত্যা-নৃশংসতার কোন খতিয়ান না থাকলেও জাতিসংঘ রিপোর্টে বলা হয়েছে মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে আরো হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গতকাল প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যের মংডুতে বর্মী বাহিনীর নৃশংসতা অব্যাহত আছে। রোহিঙ্গা মুসলমান যুবকদের তো বটেই, অসংখ্য নারী ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যার তথ্য অহরহ নানা মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে। সর্বশেষ সামিরা নামের ৩ বছরের এক শিশু বার্মিজ বাহিনীর নির্যাতনে নিহত হওয়ার ঘটনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বের সব শান্তিকামী মানুষ মিয়ানমার বাহিনীর বর্বরতার হাত থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্ষায় কিছু একটা করার প্রত্যাশা করছেন। আসিয়ান, ওআইসি এবং জাতিসংঘ এবার মানবতার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের ঔদ্ধত্যের শক্ত জবাব দিবে, এটাই বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রত্যাশা।
চলতি সপ্তায় প্রকাশিত জাতিসংঘের এক রিপোর্টে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। গত তিন মাসে ৬৫ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও শুধুমাত্র গত সপ্তাহেই ২২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে জাতিসংঘ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনের দেয়া তথ্য অনুসারে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে নিবন্ধিত আশ্রয় প্রার্থীর মধ্যে জাতিগত রোহিঙ্গা মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান শুরু হয়েছে গত অক্টোবর থেকে। মালয়েশিয়া সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যথেষ্ট সোচ্চার ও সক্রিয় থাকলেও নিকটতম প্রতিবেশী এবং রোহিঙ্গা সমস্যার অন্যতম ভুক্তভোগী হিসেবে এই সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। তবে আশার কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইতিমধ্যে ঢাকা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানের জন্য ইতিমধ্যে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছেন, এবং মিয়ানমানের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির একজন বিশেষ দূত (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) উ কিয়াই থিনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল আজ থেকে ৩ দিনের জন্য ঢাকায় অবস্থানের কথা রয়েছে। জাতিসংঘ, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার মধ্য দিয়ে ১৯ তারিখে ওআইসি সম্মেলন শুরুর আগেই রোহিঙ্গা ইস্যুটির শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে বলে আমরা আশা করি। বিশেষত, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকেই তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে। তবে জাতিসংঘ এবং ওআইসিভুক্ত দেশগুলোকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশকে আরো জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন