বিশ্বব্যাপী ইসলামের মৌলিক দাওয়াতি কাজে নিয়োজিত তবলিগ জামাতের ৫২তম শীর্ষ সম্মেলন বা বিশ্ব ইজতিমার প্রথম পর্ব আজ টঙ্গির তুরাগ নদীর তীরে শুরু হচ্ছে। এ উপলক্ষে অন্তত ২০ লাখ মুসল্লির ইজতিমাস্থলে উপস্থিতি, অবস্থান ও নিরাপত্তাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মুরুব্বীদের পক্ষ থেকে জানা গেছে। প্রতিবছরই ইজতিমায় জনসমাগম বেড়ে চলায় একসাথে বিপুল সংখ্যক লোকের ঝক্কি কমিয়ে আনতে গত কয়েক বছর ধরে দেশের ৬৪ জেলাকে দুই ভাগে বা পর্বে বিভক্ত করে ইজতিমায় অংশগ্রহণের জন্য নির্ধারিত হয়ে আসছিল। এ বছর তা আরো খ-িত করে ৩২ জেলায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট ৩২ জেলার মুসল্লিরা ২০১৮ সালের বিশ্ব ইজতিমায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। এভাবেই বিশ্ব ইজতিমার পর্ব বিন্যাস নিশ্চিত করছে প্রশাসন। মূলত: আখেরি মুনাজাতের মধ্য দিয়ে ইজতিমার সমাবেশটি মুসলিম উম্মাহর অন্যতম বৃহৎ সমাবেশে পরিণত হলেও এবারের ইজতিমা শুরুর দিনটি শুক্রবার হওয়ায় প্রতিবছরের মত এবারো ইজতিমায় দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে আজ। দ্বিতীয় পর্বের শুরুর দিনটিও ২০ জানুয়ারী শুক্রবার হওয়ায় তুরাগতীরে একই রকম লাখ লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণে জুমার জামাত অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বিশ্ব মুসলিমের বৃহত্তম দাওয়াতি কাফেলায় সমবেত ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ভাইদের প্রতি আমাদের আন্তরিক সালাম ও মোবারকবাদ।
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ভারতের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ:) চারিত্রিকভাবে বিপর্যস্ত, শিক্ষাহীন, ধর্মকর্মহীন মুসলমানদের ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দিয়ে ঈমানী বলে জাগিয়ে তুলতে দিল্লীর পার্শ্ববর্তী মেওয়াত অঞ্চলের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রথম তবলিগের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ১৩৪৫ হিজরী সনে হজ পালন করে দেশে ফিরে এসে মাওলানা ইলিয়াস যে তবলিগি গাশ্ত কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তা’ই অবশেষে সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে। তবলিগ জামাতের হেডকোয়ার্টার দিল্লীতে অবস্থিত হলেও এর বার্ষিক সম্মেলনের স্থান হিসেবে তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশকেই নির্বাচিত করা হয়। চল্লিশের দশকে প্রথম বিশ্ব ইজতিমা ঢাকার রমনার কাকরাইল মসজিদে অনুষ্ঠিত হলেও এর ক্রমবর্ধমান প্রসারের ফলে তুরাগ নদী তীরের বর্তমান স্থানটিতে বিশ্ব ইজতিমা শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। মুসলমান জনগোষ্ঠির বৃহত্তম অংশকে ইসলামের বিশ্বাস ও আক্বিদায় সমৃদ্ধ ও বাস্তব অনুশীলনে অভ্যস্ত করা না গেলে মানব সমাজে ইসলাম সম্মত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, এই উপলব্ধি থেকেই মাওলানা ইলিয়াস তবলিগ জামাতের সূত্রপাত করেছিলেন। তবলিগ জামায়াতের সুশৃঙ্খল কার্যক্রম ইতিমধ্যেই অর্ধশত বছর পার করে এসেছে। ইসলামের দাওয়াত এবং চলমান বিশ্ববাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তবলিগ জামাতের মুসল্লিদের নতুনভাবে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাগিদ অস্বীকার করা যায় না। জায়নবাদী ষড়যন্ত্র ও প্রোপাগা-ায় পশ্চিমা বিশ্ব ইসলাম সম্পর্কে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। তাদের এই ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিতে ইসলামের মহান শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির সার্বজনীন বাণী সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার কোন বিকল্প নেই। তবলিগ জামাতসহ বিশ্বের সচেতন মুসলমানদের সকলকেই সাধ্যমত এই দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সারাবিশ্বের মুসলমানরা এখন কঠিন এক দীর্ঘমেয়াদি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও জঙ্গিবাদী ষড়যন্ত্রসহ নানা ধরনের অপপ্রচার চলছে। বিশ্ব ইজতিমায় প্রতিবছর বাংলাদেশের লাখ লাখ তবলিগ সমর্থক ও তওহিদী জনতার উপস্থিতি ছাড়াও উপমহাদেশসহ সারাবিশ্ব থেকে হাজার হাজার মুসল্লির সমাবেশ ঘটে থাকে। এ বৃহত্তম সমাবেশ যেমন বিশ্বময় ইসলামের দাওয়াতি কাজকে বেগবান ও সমন্বিত করতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে, তেমনি এই বিশ্ব ইজতিমা বাংলাদেশ সম্পর্কে সারাবিশ্বে একটি ইতিবাচক পরিচয় ও ভাব-মর্যাদা গড়ে তোলারও এক বড় সুযোগ এনে দিচ্ছে। আমাদেরকে এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। পঁচিশ লক্ষাধিক মুসল্লির সমাগমে মুখরিত ২ পর্বে ৪ দিনের এই জমায়েতের স্বচ্ছন্দ যাতায়াত, অবস্থান, থাকা-খাওয়া ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেনাবাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত বিভাগ ছাড়াও বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগেও তবলিগ জামাতের খেদমতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়। বিগত বছরগুলোর মত এবারো সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ সফলভাবে এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বিশ্বের বুকে নেমে আসা যুদ্ধ, মানবিক বিপর্যয় ও অশান্তির অপচ্ছায়া দূর হোক, শান্তি, সৌহার্দ্য, নিরাপত্তা ও পারলৌকিক মুক্তির আকাক্সক্ষা পূরণ হোক, মুসলমানদের পারস্পরিক ঐক্য দৃঢ় হোক, পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে আমরা এই প্রার্থনাই করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন