একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের সাথে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি, সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিভিন্ন প্রস্তাবনা নিয়ে বৈঠক করেছে। প্রেসিডেন্ট আরও বেশ কয়েকটি দলের সাথে বৈঠক করবেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ প্রত্যেকেই একটি শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য প্রেসিডেন্টকে প্রস্তাব দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সরকারের জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের উপর আস্থা রাখার জন্য পুনরায় আহ্বান জানিয়েছেন। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। এ সময়ের মধ্যেই প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এ হিসেবে সময় খুব বেশি নেই। বৈঠক করা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন, এমন প্রত্যাশা এখন সবারই। বলা যায়, বল এখন প্রেসিডেন্টের কোর্টে। গোটা জাতিই প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে আছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রেসিডেন্টকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চলতে হয়। নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রেও তাই হওয়ার কথা। তবে ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্টকে স্পষ্ট পরামর্শ দিয়েছেন, ‘যেরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করবেন’, তেমন করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টি স্বাধীনভাবে করতে পারবেন। ধরে নেয়া যায়, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিক।
ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করা নিয়ে আস্থাহীনতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা না থাকা থেকেই একটি স্বাধীন ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দিকে দলমত নির্বিশেষে সকলে মনোযোগী হয়েছেন যে কমিশন নিজস্ব বলে বলীয়ান হয়ে এবং কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্বের ধার না ধেরে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের সময়েও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের সাথে প্রায় সবদলের বৈঠক হয় এবং সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এ নির্বাচন কমিশন কেমন হয়েছে, তা ইতোমধ্যে সকলে দেখেছেন। এ ধরনের মন্দ অভিজ্ঞতা সামনে রেখেই সকলে আশা করছেন, এবার যেন ওই রকম নির্বাচন কমিশন গঠিত না হয়। এজন্য ক্ষমতাসীন দলসহ প্রত্যেক দলই অত্যন্ত সিরিয়াস। এ পর্যন্ত যে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষিত হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে প্রত্যেকেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে বলে আশা করছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠিত না হলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক, তা তিনি চান না। তাঁর এই শুভ ইচ্ছাই সর্বজনগ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনকে অতি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আশার কথা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলও এ তাকিদ অনুভব করেছে এবং প্রেসিডেন্টের উপর সকলের আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়েছে। তবে এ আহ্বান যেন শুভংকরের ফাঁকিতে পরিণত না হয়। কারণ বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯৬ সালের রুলস অব বিজনেস-এর ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে প্রেসিডেন্টকে প্রধানমন্ত্রীর মতামত নিতে হবে। এখন যদি ক্ষমতাসীন দল একদিকে প্রেসিডেন্টকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দেয়ার কথা বলে, অন্যদিকে রুলস অব বিজনেসের কথা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেয়ার কথা বলে, তবে সকলের সর্বজনগ্রহযোগ্য নির্বাচন গঠন করার লক্ষ্যে সবার সাথে প্রেসিডেন্টের যে বৈঠক এবং প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে, তা মুহূর্তেই অসারে পরিণত হবে। আমরা ইতোমধ্যে আদালত কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী দুইটি নির্বাচন করা যেতে পারে বলে আদালত যে পরামর্শ দিয়েছিল, তার প্রথমটি ক্ষমতাসীন দল পালন করেছে। দ্বিতীয়টি পালন করেনি। যদিও দ্বিতীয়টির ব্যাপারে বিরোধী দলের প্রায় সকলের মধ্যেই ঐকমত্য ছিল। আসন্ন নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রেও যদি ক্ষমতাসীন দল রুলস অব বিজনেসের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিতে বলে, তবে পুরো প্রক্রিয়াটিই ভেস্তে যাবে। অবশ্য এ ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী যদি প্রেসিডেন্টকে এ পরামর্শ দেন যে, প্রেসিডেন্ট তার স্বাধীন মতের ভিত্তিতে নির্বাচন গঠন করবেন, তাহলে সবার গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনে আর কোনো বাধা থাকে না। এটা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার উপর। আমরা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্যে এ সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখেছি।
আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া প্রেসিডেন্ট স্বাধীনভাবে সকল দলের মতামত ও প্রস্তাবনার আলোকে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যে প্রস্তাবনা দিয়েছে, তার মূল কথাও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা। আমরা আশা করতে চাই, প্রেসিডেন্টকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার যে পরামর্শ প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তাতে তাঁর নিজের, দলের এবং মন্ত্রিসভার মতামত প্রতিফলিত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। বলা বাহুল্য, স্বাভাবিকভাবে সরকার ও দলীয় প্রধানের দুটি সত্তাকে আলাদা করা যায় না। তবে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে যেহেতু সব দলেরই প্রস্তাব ও পরামর্শ উপস্থাপন করা হয়েছে, তাই এর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক সহমত পোষণই কেবল পারে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে। কোনো বিধি-বিধানের বলে নয়, সকলের চাওয়াকে মূল্যায়ন করে প্রধানমন্ত্রী নিজ থেকে প্রেসিডেন্টকে নির্বাচন কমিশন গঠনে পরামর্শ দিবেন না, এ বিষয়টি সরকার স্পষ্ট করলে আর কোনো বাধা থাকে না। তাহলেই কেবল সব দলের প্রস্তাব ও পরামর্শ প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে পর্যালোচনা করে সকলের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে সমর্থ হবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন