শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মানবাধিকার পরিস্থিতি : এইচআরডব্লিউ’র রিপোর্ট

| প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংগঠনটির ‘ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০১৭’-তে নির্বিচারে গ্রেফতার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যম ও বেসামরিক লোকজনের ওপর সরকার দমন-পীড়ন চালিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজন আটক, পঙ্গু, হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছে। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ব্লগার, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ, সমকামী অধিকারকামী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা করতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে বর্ণিত এসব অভিযোগ সম্পর্কে সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া ও অভিমত এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কত সময় কত প্রতিবেদনই তো দেয়। না দেখে এবিষয়ে মন্তব্য করতে পারবো না।’ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমরা এখনো প্রতিবেদনটি দেখিনি। কাজেই না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না’। প্রসঙ্গত, তিনি জানিয়েছেন, জাতিসংঘের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর সারাবিশ্বে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বেশী ঘটেছে। বাংলাদেশও তাই। একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এদেশের মানুষের যেমন তা অজানা নেই, তেমনি দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও অবিদিত নেই। দেশী এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় এ সম্পর্কে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে, অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বেশী। গুম, তুলে নেয়া ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে বিগত সাড়ে ৯ বছর সাড়ে চারশ’র বেশী লোক নিখোঁজ হয়েছে, যাদের বেশীর ভাগের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেকের লাশ পাওয়া গেছে। ওই একই সংগঠনের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ১১ মাসে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১৮৪ জন, তার আগের বছর নিহত হয়েছে ১৭১ জন এবং তারও আগের বছর নিহত হয়েছে ২৫৪ জন। নিখোঁজ ও বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাবলীর অধিকাংশের ক্ষেত্রে আইন-শৃংখলা বাহিনীর ওপর দায় আরোপিত হয়েছে, যদিও আইন-শৃংখলা বাহিনী তা অস্বীকার করেছে। অনেকের অভিযোগ, আইন-শৃংখলাবাহিনী এক ধরনের দায়মুক্তি ভোগ করছে যে কারণে এধরনের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা বেশী করে ঘটছে।
রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন ও হামলা-মামলার ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এই সঙ্গে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার ঘটনাও বেড়ে গেছে। বাস্তবতা তো এই যে, রাজনৈতিক বিরোধীরা তাদের গণতন্ত্র ও সংবিধানসম্মত অধিকার যেমন, সভা-সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি কোনো কিছু করতে পারেন না। তারা কোনো কর্মসূচী ঘোষণা করলে মাঠেই নামতে দেয়া হয় না। রাজনৈতিক বিরোধীদের যে কোনো অজুহাতে গ্রেফতার ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের অতিসাধারণ এক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকারও নানা আইনের মারপ্যাঁচে সীমিত করে ফেলা হয়েছে। বেশ কিছু গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। গণমাধ্যম কর্মীদের নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও নাজেহাল করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। মানবাধিকার পরিস্থিতির এই শোচনীয় অবস্থার জন্য বিশ্লেষক পর্যবেক্ষকরা গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও দ্রুত ন্যায়বিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা না থাকা, আইন-শৃংখলা বাহিনীর ওপর সরকারের নির্ভরতা, সর্বত্র দলীয়করণ ইত্যাদিকে দায়ী মনে করেন। তারা আরো মনে করেন, ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকার এক ধরনের দুর্বলতায় ভুগছে। এক ধরনের শংকাও হয়তো আছে। একারণে ক্ষমতা নিরংকুশ ও সংহত করতে এমন কিছু করছে, যা মানবাধিকারকেই সবার আগে সবচেয়ে বেশী আঘাত ও আহত করছে।
একটি দেশ কতটা সভ্য ও সুশাসিত তা অবলোকন করা যায়, অনুধাবন করা যায় সে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভিত্তিতে। আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তুমুল সমালোচনা রয়েছে দেশে-বিদেশে। এটা দেশের জন্য মোটেই গর্বের বা আত্মশ্লাঘার বিষয় নয়। দেশের সুনাম ও মর্যাদার পক্ষে এটা কোনোভাবেই যায় না। এ পরিস্থিতির আশু অবসান একান্তভাবেই কাম্য। কেন মানবাধিকার পরিস্থিতির এহেন হীন দশা, আগে তার কারণ নির্ণয় করা জরুরি। তেমনি যত দ্রুত সম্ভব কারণগুলো দূর করা আবশ্যক। এ পরিস্থিতির জন্য গণতন্ত্রহীনতাকেই প্রধানত দায়ী মনে করা হয়। গণতন্ত্র থাকলে রাজনীতির বাধামুক্ত চর্চা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সখ্য, শ্রদ্ধা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই আইনের শাসন নিশ্চিত করতে ও বিচারহীনতার ‘সংস্কৃতি’র অবসান ঘটাতে পারে। তৃতীয়ত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা দেয়। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা ও সর্বত্র জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এমতাবস্থায়, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও ঐকমত্য সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। এবছরের শুরুতে যে অভিজ্ঞতা দেশের মানুষ অর্জন করেছে, তা আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। আবার আগামী নির্বাচন নিয়ে যে রকম কথাবার্তা হচ্ছে তাতে কিছুটা আলোর রেখাও দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারকে আরো সদিচ্ছাপ্রবণতার পরিচয় দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
MD:Humayun kabir ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:৩১ পিএম says : 0
সত সাহস সামনে রেখে মিততাকে উরিয়ে দেওয়াই সতের কাজ
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন