নারায়গঞ্জের সাত খুন মামলায় নূর হোসেন ও সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদসহ ২৬ জনের ফাঁসি ও বাকি ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। সোমবার সকাল ১০টা ৫মিনিটে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এই রায় ঘোষণা করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ রায় দিয়েছেন আদালত।এ সময় আদালতে মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে ২৩ জন উপস্থিত ছিলেন। আলোচিত এ মামলায় ৩৫ আসামির মধ্যে ১৭ জনই র্যাব সদস্য। মামলার শুরু থেকেই র্যাবের সাবেক ৮ সদস্যসহ ১২ জন আসামি পলাতক।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের কাছ থেকে তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করে হত্যার অপরাধে আসামিদের সাজার এই রায় দেন আদালত। গ্রেফতার ২৩ আসামির সবাই আদালতে উপস্থিত ছিলেন। গত বছরের ৩০ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন আদালত।
এদিকে রবিবার রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এই মামলার রায় সম্পর্কে তার প্রত্যাশার ব্যক্ত করতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশের সাধারণ মানুষ চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। যাদের কাজ জনগণের জানমাল রক্ষা করা, তারাই যদি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হন, তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।’
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় খান সাহেব ওসমান আলী জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২নং ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম অপহৃত হন। পরদিন ২৮ এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী। ওই মামলায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেনকে প্রধান করে ৬জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাই বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানায় আরও একটি মামলা করেন। ৩০ এপ্রিল বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬ জন এবং ১ মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে স্বজনরা লাশগুলো শনাক্ত করেন।
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। ২৯ ফেবব্রয়ারি থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষ হয় ৩০শে নভেম্বর। চার্জ গঠন থেকে শুরু করে মামলার ৪১তম কার্যদিবস শেষে আদালত রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন। আসামিদের মধ্যে ২৫ জন র্যাব সদস্য ও ১০ জন নূর হোসেন ও তার সহযোগী। মামলায় মোট ১০৬ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। র্যাব-১১ এর সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এমএম রানা এবং নূর হোসেনসহ ২৩ আসামির উপস্থিতিতে বিচারকার্য সম্পন্ন হয়। পলাতক ১২ আসামির পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ ৬ জন আইনজীবী নিয়োগ দেন। তারা পলাতক আসামিদের পক্ষে বিচার কার্য পরিচালনা করেন। পলাতকদের মধ্যে র্যাব’র ৮ সদস্য ও নূর হোসেনের ৪ সহযোগী রয়েছেন।
এ হত্যাকা-ে পর নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে যায়। ২০১৪ সালের ১৪ জুন রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের কাছে কৈখালী এলাকার একটি বাড়ি থেকে নূর হোসেন ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করে বাগুইআটি থানার পুলিশ। পরে ওই বছরের ১৮ আগস্ট নূর হোসেন, ওহাদুজ্জামান শামীম ও খান সুমনের বিরুদ্ধে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বারাসাত আদালতে চার্জশিট জমা দেয় বাগুইআটি থানা পুলিশ। ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দমদম কারাগার কর্তৃপক্ষ নূর হোসেনকে বাংলাদেশে হস্তান্তর করতে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এরপর ১৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ আদালতে উপস্থাপন করা হয় নূর হোসেনকে।
তিন জন তদন্তকারী কর্মকর্তার ১১ মাসের দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল ভারতের কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এজাহারভুক্ত ৫ আসামি অব্যাহতির আবেদন করা হয়। মামলায় ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। ১৬২ ধরনের আলামত উদ্ধার দেখানো হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত ৩৫জনের মধ্যে ২৩জন গ্রেফতার রয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, সাত খুনের দু’টি মামলায় গ্রেফতারকৃত ২৩ জনের উপস্থিতিতে ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে চার্জ গঠন করেন। শুনানির সময়ে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা ২৩ জনের অব্যাহতি আবেদন করলে আদালতে নাকচ করে দেন। পলাতক ১২ জনসহ সাত খুনের দুটি মামলায় অভিযুক্ত ৩৫ জনের সবার বিরুদ্ধেই চার্জগঠন করা হয়। ১২ জনের অনুপস্থিতিতেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাদের পক্ষে ৫জন আইনজীবী নিযুক্ত করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।
রায়কে ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ প্রশাসন
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের রায় সোমবার (১৬ জানুয়ারী)। এ রায়কে ঘিরে জেলা আলাদত পাড়াসহ কারাগার থেকে আসামীদের আননয়ের পথে বিশেষ নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ প্রশাসন।
মামলার ‘দুধর্ষ প্রকৃতির’ চার আসামি নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে আদালতে হাজিরের সময় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পৃথক চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠিতে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার আসামি ও কারাগারে শ্রেণীপ্রাপ্ত (ডিভিশনপ্রাপ্ত) আসামি বরখাস্তকৃত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা বিভিন্ন বাহিনীর প্রশিক্ষণ পাওয়া কর্মকর্তা। তাঁরা আসামি হিসেবে দুধর্ষ প্রকৃতির।
এদিকে, নূর হোসেনও একজন দুধর্ষ প্রকৃতির আসামি বলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা জানিয়েছে। এই অবস্থায় যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা পলায়নের অপতৎপরতা রোধে অধিক সতর্কতার জন্য শ্রেণীপ্রাপ্ত এই আসামিদের ১৬ জানুয়ারি আদালতের ধার্য তারিখে হাতকড়া পরিয়ে ও রশি বেঁধে অতি সতর্কতার সঙ্গে আদালতে হাজির করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার মঈনুল হক বলেন, রায়ের দিন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সর্ব্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে আইনশৃংখলা বাহিনী। জেলা আলাদত পাড়া ও কারাগার থেকে আসামীদের আননয়ের পথে বিশেষ সতর্কতা, অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রিজন ভ্যানেও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন