দেশে দরিদ্র মানুষদের আয় রোজগার না বাড়লেও লাগামহীনভাবে বাড়ছে মোটা চালের মূল্য। এমন নয় যে, মৌসুমে ধানের উৎপাদনে ঘাটতি ছিল। একদিকে বাম্পার ফলনের পরও ধানচাষিরা উৎপাদন খরচও উঠাতে পারছেনা, অন্যদিকে কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই লাফিয়ে বাড়ছে চালের মূল্য। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, গত ৫ মাসে মোটা চালের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে কাজ করা জাতীয় সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে চাল ও আটার মত নিত্যপণ্যের বাজার তদারকি জোরদার করার দাবী জানানো হয়েছে। তাদের বিবৃতিতেই গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি জানুয়ারী পর্যন্ত ৫ মাসে মোটা চালের মূল্যবৃদ্ধির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। একইভাবে গম ও আটার মূল্যও বেড়েছে। এমন অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ধানচালের মধ্যস্বত্বভোগী কারবারিরা লাভবান হলেও একদিকে ধানচাষি কৃষকরা যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে দেশের নিম্ন আয়ের কোটি কোটি পরিবারের জীবন ধারণ আরো কষ্টকর ও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। চালের মত নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে বাজারের সব পণ্যেই মূল্যস্ফীতির প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে।
ক্যাবের অনুসন্ধানে জানা যায়, কোন সঙ্গত কারণ ছাড়াই মাত্র ৫ মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বাজারে মোটা আতপ ও সিদ্ধ চালের দাম প্রকার ভেদে বস্তা প্রতি ৪০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানেও মূল্যের কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। বর্তমান সরকার দরিদ্র মানুষকে স্বল্পমূল্যে চাল খাওয়ানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এমনকি দরিদ্র মানুষদের কাছে ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহের সরকারী কর্মসূচিও চলছে। তবে বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির নিয়ামক সমূহ নিয়ন্ত্রণ না করে সীমিত পরিসরে ১০ টাকা দরের চাল বিক্রির কর্মসূচি গ্রহণ করে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের দুর্দশা লাঘব করা যে সম্ভব নয় তা’ সহজেই অনুমেয়। কথিত স্বল্পমূল্যের চাল বিক্রির কর্মসূচিও নানা ধরনের দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও লুটপাটের শিকার হয়েছে। এ খাতের হাজার হাজার বস্তা চাল সংশ্লিষ্ট ডিলার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে বলে বিভিন্ন সময়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল চালের মত নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি অতি দরিদ্র মানুষদের সুবিধার্থে গৃহীত বিশেষ খাদ্য কর্মসূচির সুবিধা দরিদ্র মানুষদের কাছে পৌছাতে পারছেনা।
গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, ধানের উৎপাদন খরচ না ওঠায় বা যথাযথ মূল্য না পাওয়ায় ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষকরা। এ ক্ষেত্রে ধানচাষের প্রসিদ্ধ এলাকা শরিয়তপুরের উদাহরণ দেয়া হয়েছে, সেখানে ধানচাষিরা ধানি জমিতে মাছ চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। গত চার বছরে অব্যাহত গতিতে ধানচাষের আওতা হ্রাস পাওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে প্রকাশিত রিপোর্টে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের কৃষকরা সীমিত ও ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমির উপর ভর করে গত চার দশকে দেশকে খাদ্যে প্রায় স্বনির্ভর করে তোলতে সক্ষম হয়েছেন। উচ্চফলনশীল কৃষিবীজ, শত শত কোটি টাকার রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি উপাদন বৃদ্ধির সুফল থেকে নানাভাবে কৃষকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় বাজার ব্যবস্থাপনা বা মনিটরিং ও মূল্যনিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক এবং দরিদ্র মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উপরন্তু ধানের ভরা মওসুমেও ভারত থেকে চাল আমদানীর সুযোগ করে দিয়ে ধানের মূল্যকে ভারসাম্যহীন করে এক ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। এই সংকটে কৃষকরা লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। বাম্পার ফলনের পরও উৎপাদন খরচ না ওঠার কারণে কৃষকরা ধানি জমিতে তামাক চাষ অথবা মাছের খামার গড়ে তোলতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে দেশে ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। দেশকে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট এবং দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিত্যপণ্যের বাজার মনিটরিং-এর পাশাপাশি রাইসমিল মালিক, আমদানীকারক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নজরদারির আওতায় আনতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন