শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মানবতাবিরোধী সাত খুনের রায়

| প্রকাশের সময় : ১৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনাকে মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন আদালত। এই অপরাধের দায়ে র‌্যাবের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার লে.কর্ণেল তারেক সাইদ মোহাম্মদ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন গত সোমবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন। রায় পড়া শুরুর ৭ মিনিটের মাথায় বিচারক রায় ঘোষণা করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ রায় দিয়েছে আদালত। রায়ে বিচারক বলেছেন, আদালতে হাজির করা যাবতীয় তথ্য প্রমাণও এখানে উপস্থাপিত আলোচনা বিবেচনায় রেখে আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণে বাধ্য হচ্ছি যে, প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে সফল হয়েছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র মোতাবেক যৌথভাবে অভিন্ন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ভুক্তভোগীদের অপহরণ ও হত্যা করেছে। রায়ে বলা হয়েছে, যে পদ্ধতিতে ভুক্তভোগীদের হত্যা করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবসময় অপরাধমূলক মানসিকতা ধারণ করতো এবং তারা যে অপরাধ করেছে তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। রায় প্রকাশের পর ৭ পরিবার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে নিজেদের নিরাপত্তার দাবিও জানিয়েছে। রায়ের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, এ রায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধী সদস্যদের জন্য সতর্ক বার্তা। আইনমন্ত্রী অনিসুল হক এই রায়কে আইনের শাসনের নজির হিসেবে অভিহিত করেছেন। এদিকে এ রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা।
নানা বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় গুরুত্বপূর্ণ। দেশে হত্যা, গুম ও অপহরণসহ এধরনের বিভিন্ন অপরাধে এই প্রথম একটি মামলায় ১৭ জন র‌্যাবসদস্যকে সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হয়েছে। ফৌজদারি অপরাধে একসঙ্গে এত র‌্যাব সদস্যের সাজার ঘটনাও এই প্রথম। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী বলেছেন, আদালত নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য রায় ঘোষণা করেছে। আমার প্রত্যাশা উচ্চ আদালতেও রায় বহাল থাকবে। বাদী পক্ষের অইানজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, আমরা আশা করবো উচ্চ আদালতে রায়টি বহাল থাকবে। তিনি আরো বলেছেন, এই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা, মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে উচ্চ আদালত প্রশংসনীয় ভূমিকা নিয়েছিল। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ, পরদিন মেলে আরেকটি লাশ। স্বজনরা লাশগুলো শনাক্ত করেন। নিহত বাকিরা হলেন, নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। ঘটনার পরদিন ২৮ এপ্রিল ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী। ওই মামলায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেনকে প্রধান করে ৬ জনকে আসামি করা হয়। এছাড়া আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাই বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানায় আরও একটি মামলা করেন। এদিকে, ৭ খুনের ঘটনার পর নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ তোলেন, ‘৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাবকে দিয়ে ওই সাতজনকে হত্যা করিয়েছে নূর হোসেন। এ অভিযোগের পর ২০১৪ সালের ৬ মে র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাইদ মোহাম্মদ, সাবেক অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ১৭ মে দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ঢাকার সেনানিবাস এলাকা থেকে মিলিটারি পুলিশ, ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশ ও নৌ-বাহিনীর গোয়েন্দারা এমএম রানাকে আটক করে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের কাছে তুলে দেন। পরে এ তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ হত্যাকান্ডের পর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানের সঙ্গে নূর হোসেনের টেলিফোনে কথোপকথনের বিষয়টি প্রচার করে। তখন বিষয়টি নিয়ে আরও তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সাত খুনের পর একটা বিশেষ মহলের সহায়তায় নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে যায়। ২০১৪ সালের ১৪ জুন রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরের কাছে কৈখালী এলাকার একটি বাড়ি থেকে নূর হোসেন ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করে বাগুইআটি থানার পুলিশ। পরে ওই বছরের ১৮ আগস্ট নূর হোসেন, ওহাদুজ্জামান শামীম ও খান সুমনের বিরুদ্ধে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে বারাসাত আদালতে চার্জশিট জমা দেয় বাগুইআটি থানা পুলিশ। ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দমদম কারাগার কর্তৃপক্ষ নূর হোসেনকে বাংলাদেশে হস্তান্তর করতে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এরপর ১৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ আদালতে উপস্থাপন করা হয় নূর হোসেনকে। তিনজন তদন্তকারী কর্মকর্তার ১১ মাসের দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল ভারতের কলকাতায় গ্রেফতার হওয়া নূর হোসেন,  র‌্যাবের চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এজাহারভুক্ত ৫ আসামি অব্যাহতির আবেদন করে। মামলায় ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়। ১৬২ ধরনের আলামত উদ্ধার দেখানো হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত ৩৫ জনের মধ্যে ২৩জন গ্রেফতার রয়েছেন।
আলোচিত এই সাত খুনের মামলার ১৬২ পৃষ্ঠার রায়ে আদালত গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভিমত দিয়েছেন। অভিমতে আদালত বলেছেন, এই ঘটনা সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য লজ্জাজনক। একই সাথে জাতির জন্যও লজ্জাজনক। বলা হয়েছে, অপহরণ হত্যার জন্য নূর হোসেনের মতো দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যখন যোগাযোগ তৈরি হয় তখন আমাদের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে যায়। নূর হোসেন ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের সুবিধা নেয়ার বিষয়টি অনেক প্রশ্নের জন্মদেয়। প্রকৃত বিবেচনাতেই গত কয়েক বছর ধরে যেভাবে মানুষ গুম খুনের শিকার হয়েছে সেক্ষেত্রে কেবল দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আইন-শৃঙ্খলা বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের খুনের সাথে জড়িত বাহিনীর নাম উঠে এসেছে। আমেরিকা এ কারণে র‌্যাবের প্রশিক্ষণেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর এ ধরনের ঘটনা কিছুদিনের জন্য হলেও বন্ধ ছিল। তবে তা হয়ত আবার ভিন্নভাবে হতে শুরু করেছে। বাস্তবতার বিশ্লেষণে বলা যায়, এটি কেবল হত্যার বিচার নয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে আদালতের সমুচিত রায়। নারায়ণঞ্জের সাত খুনের ঘটনা উদ্ঘাটিত হবার মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হয়েছে সত্য কখনো চাপা থাকে না। আর বিচারের রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো কেহই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এটাও প্রমাণিত হয়েছে দেশে মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়ে চলছে তারও বিচার হয়ত একদিন হবে। এ রায় আমাদের বিচার বিভাগের জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এ রায় ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিতবহ। যথাশীঘ্র রায় কার্যকর করার সব আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হোক- এ প্রত্যাশা সবার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন