সাগর, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট ও দেশের অভ্যন্তরে নানা জায়গা থেকে ইয়াবার ছোট-বড় চালান উদ্ধারের খবর প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এতে সহজেই বোঝা যায়, ইয়াবার অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনোভাবেই ইয়াবার অনুপ্রবেশ, চলাচল ও ব্যবসা রোধ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন বয়সী মানুষ বিশেষ করে তরুণরা বিপুল সংখ্যায় ইয়াবা-আসক্ত হয়ে পড়ছে, এ খবরও নতুন নয়। ইয়াবার উৎস প্রতিবেশী মিয়ানমার। সেখান থেকে স্থল, নৌ ও সাগরপথে ইয়াবা ঢুকছে দেশে। চলে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। জানা যায়, এই অবৈধ মাদকের কারবার চালু রাখতে সীমান্তের ওপারে বহু ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে চোরাচালানি চক্রের মাধ্যমে তা দেশের ভেতরে অনুপ্রবেশ করছে। ইয়াবার অনুপ্রবেশ ও আগ্রাসন রুখতে ওই কারখানাগুলোর ধ্বংস বা অপসারণ অত্যাবশ্যক। এই বিবেচনা থেকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ আসাদুজ্জামান খান কামাল মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইয়াবা কারখানাগুলো সরিয়ে নিতে। গত শনিবার বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় র্যাব-৭-এর সদর দফতরে মাদকদ্রব্য ধ্বংস করার এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে এই আহ্বান জানিয়ে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, মিয়ানমার সরকার সীমান্ত এলাকা থেকে কারখানাগুলো সরিয়ে নেবে। প্রসঙ্গত তিনি জানিয়েছেন, ভারত ইতোমধ্যেই সীমান্ত এলাকা থেকে ফেনসিডিল কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে ফেনসিডিল কারখানা সরিয়ে নিয়েছে কিনা, সে কথা জানানোর উপযুক্ত ব্যক্তি অবশ্যই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে দ্বিতীয় কোনো সূত্র-উৎস থেকে জানা যায়নি যে, ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে ফেনসিডিল কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। সীমান্ত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেনসিডিলের রমরমা ব্যবসা চলছে। এটা প্রমাণ করে, ভারত থেকে অবাধে ফেনসিডিলের অনুপ্রবেশ ঘটছে।
ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে। আর ফেনসিডিল আসে ভারত থেকে। এ কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। এতে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই যে, মিয়ানমার যদি সীমান্ত এলাকা থেকে ইয়াবা কারখানাগুলো সরিয়ে নেয় এবং ভারত সরিয়ে নেয় ফেনসিডিল কারখানা, তাহলে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের অনুপ্রবেশ হ্রাস পাবে। ‘হ্রাস পাবে’ কথাটি আমরা এজন্য বলছি যে, কারখানা সরিয়ে নেয়া কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধান হতে পারে যদি মিয়ানমার ও ভারত অবৈধ মাদক কারখানাগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় এবং এদের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এটা তারা করবে কিনা আমাদের জানা নেই। এ ব্যাপারে দুই দেশের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হতে পারে। সে উদ্যোগ বাংলাদেশকেই নিতে হবে। কারণ মাদকের গ্রাস বা আগ্রাসনের ভয়াবহ শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ বিশেষত তার তরুণরা। মাদক এমনই এক সামগ্রী যা মানুষকে নানাভাবে প্রল্ব্ধু করে। তা যেমন বাংলাদেশের মানুষকে করে তেমনি মিয়মানমার বা ভারতের মানুষকেও করে। এ কথা বলা যাবে না যে, মিয়ানমারে ইয়াবা ও ভারতে ফেনসিডিল উৎপাদিত হলেও ওই দু’দেশের মানুষ এসব সেবন করে না। মাদকাসক্তির বিস্তার কিংবা মাদকাসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা তিন দেশেরই রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে মিয়ানমার ও ভারতের নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থেই ইয়াবা-ফেনসিডিল উৎপাদন নিষিদ্ধ ও চোরাচালান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। বাংলাদেশ যেহেতু ইয়াবা-ফেনসিডিলের বড় রকমের বাজারে পরিণতি হয়েছে, সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে এ ব্যাপারে মিয়ানমার ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। সংগত কারণেই আমরা আশা করতে চাই, মিয়ানমার সরকার ও ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার আলোচনার পদক্ষেপ নেবে এবং তাতে তারা ইতিবাচক সাড়া দেবে।
দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানি চক্রের এক অভয়স্থলে পরিণত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ মাদক চোরাকারবারের একটি নিরাপদ ট্রানজিট কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। এহেন মাদকদ্রব্য নেই যা বাংলাদেশে আসে না। বাংলাদেশে আসা মাদকসামগ্রীর একটি অংশ বাংলাদেশে বাজারজাত হয়, বাকিটা চলে যায় অন্য দেশে, অন্য গন্তব্যে। মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা বা ভারতে উৎপাদিত ফেনসিডিল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বাংলাদেশই তাদের প্রধান লক্ষ্য ও বাজার। মাদক আমাদের কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে। আমাদের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। শিশু, মহিলা এমনকি বয়স্করাও মাদকে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এই সর্বব্যাপী মাদকসক্তি অনেক ক্ষেত্রেই গুরুতর অপরাধ সংঘটনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। খুন, ছিনতাই, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, ইভটিজিং, নারীর শ্লীলতাহানি ইত্যাদির মতো ঘটনার সঙ্গে মাদকের সংশ্লিষ্টতা ধরা পড়া থেকেই এটা প্রমাণিত হয়। মাদকের ভয়াবহ সর্বনাশ থেকে দেশ, সমাজ ও মানুষকে রক্ষা করতে হলে মাদকবিরাধী লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রথমেই মাদকের অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান রহিত করতে হবে। অভিযোগ আছে, মাদক কারবারে জড়িত দেশী-বিদেশী চক্রের সঙ্গে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের সম্পর্ক ও যোগসাজশ রয়েছে। সে কারণেই মাদকের অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান ও ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই অভিযোগ খতিয়ে দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে চোরাচালানের সকল রুট বন্ধ করতে হবে। সরিষায় ভূত থাকলে সেটা হবে না। দ্বিতীয়ত, মাদক চোরাচালান ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর মূল হোতা বা গডফাদাররা যাতে রেহাই না পায় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, মাদকবিরোধী গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধের দেয়াল তৈরি করতে হবে। চতুর্থত, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন