রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শেষ করার পর দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের অংশ হিসেবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি সর্বজনগ্রাহ্য ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে গতমাসে শুরু হওয়া প্রেসিডেন্টের সংলাপ শেষ পর্যায়ে। বিএনপি’র পক্ষ থেকে দেয়া ১৩ দফা সুপারিশের পর প্রেসিডেন্ট দেশের নিবন্ধিত প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের অংশ হিসেবে প্রথমেই বিএনপির সাথে বসেন। গত ১২ জানুয়ারী সরকারীদল আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপের মধ্য দিয়ে বড় দলগুলোর সঙ্গে এই সংলাপ শেষ। প্রেসিডেন্টের সংলাপে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশসমূহ মূল্যায়ন করে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে প্রথমেই একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুসারে নির্বাচন কমিশন গঠনের এখতিয়ার প্রেসিডেন্টের হাতে থাকলেও প্রেসিডেন্ট দুটি ছাড়া সকল ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা একটি শক্তিশালী ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের মূল অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে প্রেসিডেন্টের সংলাপ এবং সার্চ কমিটি অতীতেও হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানও বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে রকিব কমিশন গঠন করেছিলেন। সে সময়ও প্রেসিডেন্ট বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। মূলত, সরকারীদলের অনড় অবস্থানের কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী একটি বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাস তৈরী হয়।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফা ও অগ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গভীর সংকটে পতিত হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো সে নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি ক্রেডিবল ইলেকশনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনকে একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যথাশীঘ্র আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এখন আর কেউ মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবী না তুললেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারীদলের পক্ষ থেকে নানা ধরনের কথাবার্তা ও প্রস্তুতিমূলক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, গত ৬ বছরেও সরকার ও বিরোধীদল বিএনপি’র মধ্যে জনগণের প্রত্যাশিত রাজনৈতিক সংলাপের কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে খোদ জাতিসংঘ মহাসচিবের তরফ থেকে দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সকলের মতামতের আলোকে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করার মধ্য দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীর গ্যারান্টি পাওয়া যায়না। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারের একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখাই কেবল দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদলের গ্যারান্টি দিতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে প্রেসিডেন্ট যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালানোর কথা বলেছেন, তার মধ্যে দেশের জনপ্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটেছে।
গণতন্ত্রে দল ও মতের পার্থক্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিরই অংশ। পারস্পরিক মতভিন্নতা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান প্রধান জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সুসংহত হতে পারে। অসহিষ্ণুতা ও নির্মূল করার রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে কখনো গণতান্ত্রিক রাজনীতি হয়না। আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি রচিত হয়। বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে ভারসাম্যহীন ও একদলীয় নির্বাচনের সংস্কৃতি বাংলাদেশে তৈরী হয়েছে তা দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রার পথকেই বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে। গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী আন্দোলন-সংগ্রাম না থাকলেও দেশে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান হয়নি। একইভাবে আইনের শাসন, জননিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অত্যন্ত নাজুক। অথচ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিকভাবে প্রতিবেশী যে কোন দেশের চেয়ে বাংলাদেশের আরো দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান সরকার যখন দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাস্তবায়নের নানাবিধ রূপরেখা বিশ্বের সামনে তুলে ধরছে, তখন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রেসিডেন্টের সংলাপ জাতির সামনে যে নতুন প্রত্যাশা জাগিয়েছে, প্রেসিডেন্টের সর্বশেষ আহ্বানের মধ্যে তারই অনুরণন শোনা গেল। নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচনব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে শক্তিশালী, গ্রহণযোগ্য করতে একটি স্থায়ী কাঠামো গড়ে তোলা আবশ্যক। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করে তুলতে প্রধানমন্ত্রী তার সদিচ্ছার কথা ইতিমধ্যেই ব্যক্ত করেছেন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের রাজনৈতিক সংকটের সুরাহা হতে পারে। প্রেসিডেন্ট এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রশ্নে বিএনপি’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানানো হলেও আওয়ামী লীগের অনিচ্ছার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এবার প্রেসিডেন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্ষমতাসীনরা তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রমাণ রাখবেন বলে সকলে আশা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন