রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বকেয়া ঋণ আদায়ে ফের কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা শুরু করেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো এ পর্যন্ত ১৮ লাখেরও বেশি মামলা করেছে কৃষকের বিরুদ্ধে। শুধুমাত্র গত নভেম্বরেই করেছে ৪৯৩টি মামলা। মামলাগুলোর বেশির ভাগই সার্টিফিকেট মামলা। এসব মামলায় অনেক কৃষকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তারা এখন পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছে। ভুয়া ঋণ, যা খেলাপি হয়েছে; তার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই ঋণগ্রহীতাদের খোঁজ পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো তাদের দায় এড়াতে এ ধরনের মামলা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বছর কৃষকের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে মামলা করার প্রেক্ষিতে সরকার মামলা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তিনটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে কৃষকের কিছু সুবিধা প্রদান করা হয়। প্রজ্ঞাপনে কৃষকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করতে বারণ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মোটেও ভালো খবর নয়। ব্যাংকের কতিপয় শাখা ব্যবস্থাপকের কারণেই মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেছেন, যদি কোনো ব্যবস্থাপক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নতুন করে কৃষকের বিরুদ্ধে আরো মামলা করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেয়া হবে।
অভিজ্ঞতা এই সাক্ষ্য দেয়, বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া কৃষকরা ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ফসলহানি কিংবা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণেই সাধারণত তারা ঋণ পরিশোধে অপারগ হয়ে পড়ে। এছাড়া নিয়ম মতোই তারা ঋণ পরিশোধ করে। অন্যান্য খাতের সঙ্গে কৃষি খাতের ঋণ পরিশোধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, কৃষকরা ঋণ পরিশোধে অগ্রগামী অবস্থানে রয়েছে। অনিবার্য কারণে যখন তারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের এই ব্যর্থতার দিকটি গভীর সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। তাদের এমন সুবিধা ও সুযোগ দেয়া উচিত যাতে তারা ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য অর্জনের সময় পায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো, যারা প্রধানত কৃষিঋণ প্রদানের সঙ্গে জড়িত, এই বিবেচনার ধার না ধেরেই মামলা দায়েরের পথ বেছে নেয়। বিশেষ করে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করে। এই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে কৃষককে হয় পালিয়ে বেড়াতে হয়, না হয়, সহায়-সম্পদ বিক্রী করে ঋণ পরিশোধ করে সর্বস্বান্ত হতে হয়। অতীতে এ ধরনের মামলা হয়রানি ও ক্ষতির কারণে উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এটা খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার যে, মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্যও মামলা হয়েছে। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩১ হাজার টাকার বিপরীতে গড়ে একটি মামলা হয়েছে। অথচ অন্যান্য খাতে শত শত কোটি টাকা রয়েছে একেকজন ঋণ গ্রহীতার কাছে। জানা যায়, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫০ জন খেলাপির কাছেই আটকে থাকা ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। কৃষকের কাছে বকেয়া ঋণের পরিমাণ মোট খেলাপি ঋণের মাত্র ০.৮৬ শতাংশ।
কৃষিঋণ অধিকাংশ কৃষকের জন্যই জরুরি। কৃষিঋণের প্রচলন ও ব্যবস্থা এ কারণেই। কৃষিতে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী বিনিয়োগ করতে হয়। মধ্য ও প্রান্তিক কৃষকের পক্ষে এই বিনিয়োগ করা সম্ভব হয় না। চাষাবাদের খরচসহ ফসল ওঠানো পর্যন্ত যে অর্থের প্রয়োজন হয় তার জন্য ব্যাংক, এনজিও কিংবা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হতে হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক ঋণ হলো ব্যাংকঋণ। অথচ এ জন্য তাদের নানাভাবে হয়রানি ও ক্ষতির শিকার হতে হয়, যা অনাকাক্সিক্ষত। আমরা জানি, বড় বড় ঋণ খেলাপি ঋণ মওকুফের সুবিধা পায়, তাদের ঋণ অবলেপন হয়। কৃষক এ সুবিধা পায় না, তার বিরুদ্ধে হয় মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা। এই বৈপরীত্য কাম্য নয়। কৃষকের বকেয়া ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ দরকার। সন্তোষজনক কারণে যারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না তাদের ঋণ মওকুফ করা যেতে পারে। ঋণের সুদ মওকুফ কিংবা বেশী সময় দিয়ে সহজ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। কৃষকের ঋণের জাল থেকে মুক্ত করতে হবে উৎপাদন ও জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই। নতুন মামলা দায়ের বন্ধ করতে হবে। যেসব মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, অবিলম্বে সে সব পরোয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন