শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কিশোর অপরাধ : কারণগুলোর দিকে নজর দিতে হবে

সম্পাদকীয়-১

| প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্ভর করে দক্ষ-সুশিক্ষিত জনসম্পদ ও যোগ্য নেতৃত্বের উপর। একদিকে শিক্ষাব্যবস্থার মানহীনতা, অন্যদিকে সামাজিক-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার কবলে পড়া নতুন প্রজন্মের একটি অংশ ক্রমবর্ধমান হারে বিপথগামিতা ও ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় দেশের সমাজচিন্তক ও সাধারণ অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। যে বয়েসে কিশোর-তরুণদের স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই, খেলাধুলা ও পাবলিক পরীক্ষায় ভাল ফলের প্রস্তুতিতে নিবদ্ধ থাকার কথা, সে বয়েসের হাজার হাজার কিশোর-তরুণ এখন মাদকাসক্তিসহ নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত উঠতি বয়েসী কিশোর-তরুণদের ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এক সময় চিহ্নিত অপরাধী ও দাগী সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদিবাজি, হত্যা-গুম-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটত। সে সব চিহ্নিত অপরাধী এক সময় গা ঢাকা দেয়ায় অপরাধচিত্রে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও এখন শহরের পাড়া-মহল্লা ও স্কুল-কলেজের উঠতি বয়েসী কিশোরদের দৌরাত্ম্য যেন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। তারা সংঘবদ্ধভাবে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি নিজেরা পরস্পরের প্রতি সহিংস হয়ে একের পর এক হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকা শহরেই গত দুই মাসে কিশোরদের হাতে অন্তত ৫টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে।
গত ৬ জানুয়ারী রাজধানীর উত্তরায় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আদনান সমবয়েসী কিশোরদের হাতে খুন হয়। এর আগে ডিসেম্বরে লালবাগের আবু সালেহ রাব্বী, তার আগে নভেম্বরের ২৯ তারিখে কামরাঙ্গির চরে খুন হয় আলিফ নামে আরেক কিশোর। এসব হত্যাকা-ের সাথে যারা জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায়, তাদের সকলেই উঠতি বয়েসী কিশোর। হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে বিশেষ গুরুত্ব পেলেও এসব উঠতি কিশোর প্রতিদিনই কোথাও না কোথায় সন্ত্রাস-অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে, যার সব তথ্য গণমাধ্যমে উঠে আসছেনা। আমরা যখন আগামী দশকের শেষে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, তখন আমাদের কিশোর-তরুণরা ব্যাপকহারে মাদকাসক্তি, মাদক ব্যবসায়সহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। হাজার হাজার কিশোর-তরুণ উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী হয়ে ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ার এই বাস্তবতা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এ এক ভয়াবহ অশনি সংকেত। সরকার যখন অবকাঠামো খাতে মেগা প্রকল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে জাতির সামনে আশাব্যঞ্জক রূপকল্প হাজির করছে, তখন আমাদের কিশোর-তরুণদের একটি বড় অংশ সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে বসেছে। এ সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং বিপথগামিতার কবল থেকে নতুন প্রজন্মকে টেনে তোলার সামাজিক রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া সরকারের উন্নয়নের গতানুগতিক কর্মসূচি ও রাজনৈতিক শ্লোগানবাজি উন্নত সমাজ গঠনে কোন কাজে আসবেনা।
রাজনীতি, শাসনব্যবস্থা, উন্নয়ন, গণতন্ত্র, সংবিধান ইত্যাদি সবকিছুর লক্ষ্য হচ্ছে দেশের মানুষ তথা মানব কল্যাণ। শিশু-কিশোরদের নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা, বিজাতীয় অপসংস্কৃতি, মাদকাসক্তি ও অপরাধ প্রবণতার মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা উন্নত, সমৃদ্ধ, সম্ভাবনাময় ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ আশা করতে পারিনা। আজকের কিশোর-তরুণদের মধ্যে সৃষ্ট অপরাধ প্রবণতা ও বিপথগামিতা একদিনে হঠাৎ করেই দেখা দেয়নি। এটি দীর্ঘদিনের সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফল। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়া, পরিবারে বিশৃঙ্খলা, হতাশা, অর্থনৈতিক দৈন্য, কর্মসংস্থানে অনিশ্চয়তা, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও ঘাটতি ইত্যাদি কারণে কিশোর-তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়ছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। আর এসব সমস্যার নেপথ্যে কাজ করছে দেশে বিরাজমান সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অনিশ্চয়তা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অনিয়ন্ত্রিত আকাশ সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, মাদক ও ক্ষুদ্রাস্ত্রের সহজলভ্যতার মত বিষয়। পরিবার থেকেই শিশুদের শিক্ষা ও নীতি-নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে ওঠে। মূলত আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং পরিবারের পিতা-মাতার উদাসীনতা ও অযোগ্য নেতৃত্বের কারণেই কিশোর-তরুণদের মধ্যে হতাশা ও বিপথগামিতার জন্ম হচ্ছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণে পিতামাতার হতাশা ও রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক অনিশ্চয়তা শিশু-কিশোরদের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে থাকে। তথাকথিত উন্নয়নের জিগির যতই উচ্চকিত হোক, সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন ও সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা না গেলে এ অবক্ষয় দূর করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়েও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সামাজিক-রাজনৈতিক হতাশা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মাদক এবং অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। উঠতি বয়েসী সন্তানদের লেখাপড়া, আচরণ ও চলাফেরার উপর নজরদারি বাড়াতে হবে পিতা-মাতাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি পরিবার এবং রাষ্ট্রীয় অনুশাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যেতে পারে। অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে মানুষের মানবিসত্তার বিকাশ ও সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তার গুরুত্ব অনুধাবন করেই সরকারকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন