মো. আবুল খায়ের স্বপন
॥ এক ॥
“তোমরা আল্লাহর নিকট আন্তরিকভাবে তাওবা কর” আল কোরআন। মহান আল্লাহ পাক মানুষ জাতিকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করে এবং উত্তম মর্যাদা প্রদান করে কেবল তারই ইবাদত করার উদ্দেশ্যেই এ জগতে প্রেরণ করেন। কিন্তু আমরা মানুষ জাতি আল্লাহ পাকের সে মহান উদ্দেশ্যের কথা ভুলে শয়তানের প্ররোচনা আর নফসের কু মন্ত্রণায় তারই নির্দেশ অমান্য করে জেনে, শুনে, বুঝে, না বুঝে, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় বিভিন্ন পাপাচার, অনাচার এবং অপরাধে লিপ্ত হই। এসব অপরাধের ফলে পরকালে আমাদেরকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে এতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ এবং সংশয়ের অবকাশ নেই। যেহেতু মহান আল্লাহ পাক আমাদের জন্য অত্যন্ত মেহেরবান, পরম করুণাময় সেহেতু তিনি আমাদেরকে পরকালে এসব অপরাধের শাস্তি থেকে মুক্তি এবং জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে কিছু আমল শিক্ষা দিয়েছেন। তার মধ্যে তাওবা একটি শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম আমল। কেননা প্রতিটি পাপ কাজ সংগঠিত হওয়ার পর পরই প্রত্যেক মানুষেরই মহান আল্লাহর দরবারে বিনম্র এবং আন্তরিকভাবে তাওবা করা একান্ত অপরিহার্য দায়িত্ব এবং কর্তৃব্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা নূরে এরশাদ করেন, “হে মুমিনগণ তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ এবং দয়া না থাকলে এবং আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, প্রজ্ঞাময় না হলে কত কিছুই যে হয়ে যেত”।
তাছাড়া একই প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আরও বর্ণিত আছে, “হে মুমিনগণ তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, তাহলে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে”। পাপীদের প্রতি আল্লাহর অপরিসীম মেহেরবানির কথা উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনের সূরা ইমরানে আরও এরশাদ করেন, “তারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোন মন্দ কাজে জড়িয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজ পাপের জন্য (অনুতপ্ত) হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করেন”? তাওবার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে হাদিসে হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, “হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির চার হাজার বছর পূর্বে আরশের চারদিকে লিখে রেখেছেন যে ব্যক্তি তাওবা করে, ঈমান আনে এবং নেক আমল করে আমি তার জন্য ক্ষমাকারী”। অন্যদিকে বান্দা কর্তৃক অন্যায় করার পরও অনুতপ্ত এবং লজ্জিত না হওয়া জালিমের পরিচায়ক তা উল্লেখ করে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা হুজরাতে এরশাদ করেন, “যারা তাওবা করে না তারা অত্যাচারী”। তাওবার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো আসতাগফিরুল্লাহ, অর্থ আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। অন্যভাবে বলা যায়, বান্দার দ্বারা আল্লাহর নিষেধকৃত কোন অপরাধ সংগঠিত হয়ে গেলে বান্দা সে অপরাধের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাকেই তাওবা বলা হয়। তাওবার ক্ষেত্রে মুখের উচ্চারণই যথার্থ নয়। বরং তিনটি বা চারটি শর্তের সমন্বয়ে তাওবা পরিপূর্ণ করতে হয়। অন্যায় ও অপরাধ যদি বান্দা এবং আল্লাহ সম্পর্কিত হয় তবে এ ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত সাপেক্ষ তাওবা করতে হয়।
যথা তৎক্ষণাৎ গুনাহ হতে বিরত থাকতে হয়। গুনাহের জন্য লজ্জিত হতে হয়। পুনরায় গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করতে হয়। আর অন্যায় ও অপরাধ যদি বান্দা সম্পর্কিত হয় তবে এ ক্ষেত্রে আরও একটি শর্ত পালন করে তাওবা করতে হয় তা হলো বান্দার সাথে বিরোধের বিষয়টি সুরাহা করে নিতে হয়। আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তির জন্য বেশি বেশি দোয়া এবং তার পক্ষ থেকে দান-সদকা করতে হয়।
তাওবার এ শর্তসমূহ পূরণ করে তাওবা করলেই আল্লাহর দরবারে সে তাওবা কবুল হওযার আশা করা যায়। কেননা সঠিক এবং পরিপূর্ণভাবে তাওবাকারীর মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি এবং এতে আল্লাহ অনেক বেশি খুশি হন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা নূরে এরশাদ করেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা করো, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে”। তাছাড়া তাওবার প্রতি বান্দাদেরকে উৎসাহিত করে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা তাওবায় উল্লেখ করেন, “তারা কী একথা জানতে পারেনি যে, আল্লাহ নিজেই স্বয়ং বান্দাদের তাওবা কবুল করেন, বস্তুত আল্লাহই তাওবা কবুলকারী ও করুণাময়”। একই প্রসঙ্গে হাদিসে এরশাদ আছে, “কোনো লোক বিজন মরু প্রান্তরে উট হারিয়ে যাবার পর পুনরায় তা ফেরত পেলে যে পরিমাণ আনন্দে উদ্বেলিত হয় মহান আল্লাহ বান্দার তাওবাতে তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হন”।
তাওবার সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সংগঠিত অপরাধমূলক কৃতকর্মের জন্য বান্দার আল্লাহর দরবারে তওবা করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, “পশ্চিম দিক হতে সূর্যোদয়ের আগেই (কিয়ামতের পূর্বেই) যে তাওবা করে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন”। কারণ তাওবার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে আল্লাহ পাক তাওবা কবুল করেন না। এ প্রসঙ্গে কোরআনের সূরা নিসায় এরশাদ রয়েছে, “ঐসব লোকদের জন্য তাওবা নেই, যারা পাপ কাজ করতে থাকে এমনকি যখন মুত্যু এসে যায়, তখন বলতে থাকে এখন তাওবা করছি”। হাদিসে আরও উল্লেখ আছে, “আল্লাহ পাক বান্দার তাওবা কবুল করতে থাকবেন তার মৃত্যু লক্ষণ প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত”। তাওবার ফজিলত অপরীসীম। তাওবা করার ফলে আল্লাহ এবং তদীয় রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ পালন করা হয়। যার ফলে ইহকালীন এবং পরকালীন জীবনে অনেক সৌভাগ্য, কল্যাণ এবং মুক্তি অর্জিত হয়।
তাছাড়া মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ করা হয় যার ফলে বান্দার পক্ষে আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করা সহজ হয়। তাওবার মাধ্যমে কেবল গুনাহ মাফই হয় না বরং গুনাহ মাফের সাথে সাথে তাওবার উছিলাতে আল্লাহ পাক তাদের গুনাহসমূহকে নেকি দ্বারা পরিবর্তিত করে দেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের সূরা ফোরকানে এরশাদ করেন, “কিন্তু যারা তাওবা করে, বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গুনাহগুলোকে নেকি দ্বারা পরিবর্তিত করে দিবেন”। তাওবা কেবল অপরাধ করার সাথেই সম্পর্কিত নয় বরং অপরাধ ছাড়াও তাওবা করা যায়। যা একটি উত্তম আমল। নবীজি (সা.) খুব বেশি তাওবা, ইস্তেগফার করতেন। অথচ জীবনে নবীজি (সা.) কোন গুনাহই করেননি। সকল প্রকার গুনাহ থেকে আল্লাহ পাক নবীজি (সা.)-কে সর্বদা মুক্ত রাখেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত আছে, নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, “আল্লাহর শপথ, আমি দিনে সত্তর বারের অধিক আল্লাহর নিকট তাওবা, ইস্তেগফার করি”। মুসলিম শরীফে নবীজি (সা.) আরও এরশাদ করেন, “হে মানব ম-লী, তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর। কেননা আমি দিনে একশ’ বার তাওবা করি”।
তাওবার ক্ষেত্রে আত্মার বিনয়ই প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। আর রাতের গভীরেই আত্মার বিনয়টা বেশি নিবেদন করা যায়। খালেস তাওবার প্রতিদান ক্ষমা। আর এ ক্ষমার বিনিময়ে পাওয়া যাবে পরকালে মুক্তি আর চির শান্তির নিবাস জান্নাত। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত আছে, “জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে গর্ভবতী হয়ে গিয়েছিলেন। সে নবীজি (সা.)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমি হদ বা শাস্তির উপযুক্ত হয়েছি। আমার উপর তা (শাস্তি) কার্যকর করুন। নবীজি (সা.) তার অভিভাবককে ডেকে বললেন, একে নিয়ে যাও। তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। সন্তান ভূমিষ্ট হলে তাকে আমার নিকট নিয়ে এসো। মহিলার অভিভাবক তাই করলেন। এবার নবীজি (সা.) তাকে কাপড় দিয়ে বেঁধে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার ফরমান (আদেশ) জারি করলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন