দীর্ঘ প্রায় এক দশকের আলোচনার পর ২০১৫ সালে সম্পাদিত ১২ জাতির ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসনের আগ্রহে সম্পাদিত এই বাণিজ্যিক চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়ায় অন্য দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা দিয়েছে। সম্পাদিত হওয়ার পর জাপানসহ কোন কোন দেশ ইতিমধ্যে চুক্তিটিকে তাদের সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় র্যাটিফাই করেছে বলেও জানা যায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী ইশতেহারে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারকে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি তার বাস্তবায়ন করেছেন। টিপিপি’র মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে নতুন অর্থনৈতিক মেরুকরণের যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল তা’ অনেকটাই নস্যাৎ হয়ে গেল। টিপিপিতে বাংলাদেশের অবস্থান না থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম একক রফতানিবাজার হওয়ায় এবং বাংলাদেশের গার্মেন্টস রফতানির অন্যতম আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামসহ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মত এশীয় দেশ এই চুক্তির সদস্য রাষ্ট্র হওয়ায় চুক্তিটি বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছিল। টিপিপি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের ঘটনাকে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের জন্য একটি স্বস্তিদায়ক ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানি খাতে যুক্তরাষ্ট্র সবচে বড় বাজার হওয়া সত্ত্বেও চলতি দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের ছন্দপতন ঘটে। বিশেষত বারাক ওবামা প্রশাসন জিএসপি সুবিধা বাতিলের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের তৈরী পোশাক রফতানিকারকরা যথেষ্ট সাফল্যের সাথে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তবে কথিত টিপিপিতে ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্তির কারণে বাংলাদেশের বাজার হারানোর যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল আপাতত তা’ দূরীভূত হওয়ায় আমাদের রফতানিকারকরা কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। বিগত দশকে নানা চড়াই-উৎরাই ও প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক রফতানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে তাদের যোগ্যতা ও সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধুমাত্র টিপিপি বাতিল করেই বসে থাকবেন, এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। তিনি আগেই আমদানির উপর উচ্চহারের করারোপ করার ঘোষণা দিয়েছেন। নিম্নআয়ের দেশ হওয়া সত্ত্বেও এমনিতেই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত, উপরন্তু বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য উচ্চ করের আওতায় পড়লে তা’ আবারো বড় ধরনের সঙ্কট হয়ে দেখা দিতে পারে। এ আশঙ্কাকে সামনে রেখে নতুন মার্কিন প্রশাসনের সাথে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালসহ একটি কার্যকর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ ও প্রস্তুতি নিতে হবে।
টিপিপিভুক্ত ১২টি দেশের রফতানি বাণিজ্য বিশ্ববাণিজ্যের প্রায় ৪০ ভাগ। চুক্তির মূল উদ্যোক্তা ও অনুঘটক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টিপিপি থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয়ায় বিশ্ববাণিজ্যের সম্ভাব্য চিত্রটিই হয়তো পাল্টে যাবে। বিশেষত চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বড় বিনিয়োগকারীদের তৈরী পোশাক খাতসহ সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে ভিয়েতনাম বা মালয়েশিয়ার মত দেশে বাড়তি বিনিয়োগের যে সম্ভাবনা ছিল পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তা’ সহজেই বাংলাদেশে আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর বাস্তব উদ্যোগটি বাংলাদেশকেই নিতে হবে। প্রথমত, নতুন মার্কিন প্রশাসনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ, দ্বিতীয়ত, দুই দেশের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক বিনির্মাণে কূটনৈতিক চ্যানেলের পাশাপাশি এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ এবং আমেরিকান চেম্বারের মত সংস্থাগুলোকে কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষত জিএসপি পুনরুদ্ধারের ইস্যু থেকেই বোঝা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বাণিজ্যিক চুক্তি ও দরকষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা যথেষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টিপিপি থেকে সরে আসার পর ট্রেড ক্রিয়েশন এবং ট্রেড ডাইভার্সিফিকেশন বা বাণিজ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের রফতানি খাত পণ্য ও বাজারের বিস্তৃতি ঘটানোর সুযোগ নিতে পারে। আমাদের মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি বাতিলকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে কারখানার কমপ্লায়েন্সের পাশাপাশি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জননিরাপত্তা এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে যেমন এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে বৈদেশিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের অনুকূলে কাজে লাগানোর কার্যকর উদ্যোগগুলোর সাথে দেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার রাজনৈতিক উদ্যোগও সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন