নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে আগের সার্চ কমিটির প্রধান আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। সদস্যরা হলেন, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সিএজি মাসুদ আহমেদ, পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি শিরিন আখতার। কমিটি পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগে প্রেসিডেন্টের কাছে নামের প্রস্তাব করবে। প্রস্তাবিত নামগুলো থেকে প্রেসিডেন্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবেন। প্রেসিডেন্ট নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার ভিত্তিতে সার্চ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং এই কমিটি গঠন করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনা সার্চ কমিটি গঠনে কতটা ভূমিকা রেখেছে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। দেখা গেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে মরহুম প্রেসিডেন্ট মোঃ জিল্লুর রহমান যে নীতি-প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট তা হুবহু অনুসরণ করেছেন। তখনও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর সার্চ কমিটি গঠন করা হয় এবং সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত নামের তালিকা থেকে প্রেসিডেন্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ করেন। সে সময়ে গঠন করা বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা, যোগ্যতা, সক্ষমতা, কথাবার্তা, আচরণ ও ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, যার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। শুধু এটুকু স্মরণ করাই যথেষ্ট, এ রকম ব্যর্থ, অক্ষম, নতজানু ও দলবাদী নির্বাচন কমিশন অতীতে একটিও গঠিত হয়নি।
কথায় বলে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে।’ সার্চ কমিটির যে চেহারা-সুরত দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে, তাতে আগামী নির্বাচন কমিশন কেমন হবে, কারা ওই নির্বাচন কমিশনে আসতে পারেন তা অনেকটাই আন্দাজ করে নেয়া যায়। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, যার নেতৃত্বে পূর্বের সার্চ কমিটি গঠিত হয়, এবারও তাকেই প্রধান করা হয়েছে। তার নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রস্তাবিত নামের মধ্য থেকেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। এখন তিনি বা তার কমিটি-সদস্যরা কাদের নাম প্রস্তাব করবেন সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। আগের সার্চ কমিটিতে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি সদস্য ছিলেন। আর ছিলেন সিএজি ও পিএসসি’র চেয়ারম্যান। এবারও সেভাবে কমিটি গঠিত হয়েছে। নতুন করে কমিটিতে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি। আগের সার্চ কমিটি ছিল চার সদস্যবিশিষ্ট এবং এবারের কমিটি ছয় সদস্যবিশিষ্ট। লক্ষণীয়, সার্চ কমিটিতে দুটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে সদস্য করা হয়েছে যাদের নিয়োগকে সাধারণত রাজনৈতিক নিয়োগ বলে অভিহিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসিও রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অবশিষ্ট সদস্যদের পরিচয়ও কম বেশী অনেকেরই জানা। আশা করা হয়েছিল, সার্চ কমিটি এমন ব্যক্তিদের নিয়ে করা হবে যারা হবেন দলনিরপেক্ষ ও সকল মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য। বাস্তবে তা হয়নি বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। এতে বিভিন্ন মহলে হতাশা দেখা দেয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের অভিভাবক। তিনি দলীয় মনোনয়নে ওই পদাধিকার অর্জন করলেও দায়িত্ব পালনে সব সময়ই দল নিরপেক্ষ থাকবেন, এটাই প্রত্যাশিত। এই প্রত্যাশা তিনি কতটা পূরণ করতে পেরেছেন সেটা অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য। সার্চ কমিটিতে দেশবাসী সন্তুষ্ট হতে পেরেছে, এসব মনে করার কারণ নেই। বলা যায়, জাতি ও জনগণের প্রতি প্রেসিডেন্ট যথেষ্ট সুবিচার করতে পারেননি। আশা ছিল, তার সিদ্ধান্তে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন হবে, তা হয়নি। তিনি পূর্ব নজির অনুসরণ করে একই প্রক্রিয়ায় সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ চেয়ে পাঁচটি দেশের রাষ্ট্রদূতের আবেদনে সরকার সাড়া দিচ্ছে না। ওই পাঁচ রাষ্ট্রদূতের আবেদনে সাড়া না দেয়া প্রথা-বিরোধী। এটা সরকারের ভাবমর্যাদার জন্য অনুকূল নয়। এই প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, অনুগত একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যেই সরকার এগিয়ে যাচ্ছে।
সার্চ কমিটির ব্যাপারে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন জোট সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট হতাশা ব্যক্ত করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সার্চ কমিটিকে সরকারের পছন্দের কমিটি বলে দাবি করেছেন। বলেছেন, মহামান্য প্রেসিডেন্ট যে কমিটি দিয়েছেন, তাতে আমরা শুধু হতাশ হয়নি, আমরা ক্ষুব্ধও হয়েছি। সার্চ কমিটির অন্যতম সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি মিডিয়াতে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, কী নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে সেটা তার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট। তিনি হতাশা ব্যক্ত করে আরও বলেছেন, জাতিকে রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত করার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল প্রেসিডেন্ট তা গ্রহণ করলেন না। জাতিকে আরেকটি অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়া হলো। পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, গঠিত সার্চ কমিটি যদি সততা, আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে অর্পিত কর্তব্য সম্পাদন করেন তবে শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভবপর হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা যেমন প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে প্রেসিডেন্টের দৃঢ় ভূমিকাও অত্যাবশ্যক। এতকিছুর পরও আমরা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন হবে বলে আশা করি। সার্চ কমিটি জাতির আকাক্সক্ষা পূরণে যথাযথ ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করি। আমরা এও আশা করি, প্রেসিডেন্ট জাতিকে হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে দেবেন না। একটি শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক এবং এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূরীভূত হওয়ার পথ খুলে যাক, এটাই আমাদের একান্ত কামনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন