পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে উঠেছে বিপজ্জনক কেমিক্যালের শত শত গুদাম ও কারখানা। এসব গুদাম থেকে মাঝে মধ্যেই ভয়াবহ অগ্নিকা- সংঘটিত হয়ে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে মানুষ। সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনাটিও পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদামেই সংঘটিত হয়েছিল ২০১০ সালে। নিমতলির নবাব কাটরার সে দুর্ঘটনায় ১২৪ জন জীবন্ত মানুষ পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। সে সময় পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে এসব বিপজ্জনক কেমিক্যাল গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেয়ার জোরালো দাবি উঠেছিল এবং সরকারও এসব কারখানা সরিয়ে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। কিন্তু গত ৬ বছরেও সরকারের সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিবছরই এখানে কোন না কোন কেমিক্যাল গুদাম বা কারখানায় অগ্নিকা-ে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ইসলামবাগে প্লাস্টিকের কারখানায় আগুন লেগে অন্তত ১০ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বংশালের একটি জুতার কারখানায় অগ্নিকা-ে একজনের মৃত্যু এবং আরো দুইজন মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছেন বলে প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়। পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না, গড়ে ওঠা শত শত ক্ষুদে কারখানায় ব্যবহৃত হয় উচ্চমাত্রার দাহ্য বিস্ফোরক রাসায়নিক। কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় এসব রাসায়নিকের গুদামও সেখানে গড়ে উঠেছে। ন্যূনতম নিরাপত্তা সতর্কতা বা অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা না থাকায় এসব বাড়ি একেকটা বিস্ফোরকের গুদামের মতই বিপজ্জনক।
গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, পুরান ঢাকার এসব এলাকায় ৪শ’ ভবনে গড়ে উঠেছে কেমিক্যাল গুদাম। এসব গুদামে অগ্নিকা- যে কোন সময় নিমতলির মত বিভীষিকাময় ট্রাজেডির জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই নিমতলি দুর্ঘটনার পর ২ মাসের মধ্যে পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক কেমিক্যাল গুদাম সরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। বরং কেমিক্যাল গুদামের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। পর্যাপ্ত রাস্তা ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা না থাকলেও একেকটি বহুতল ভবনের নিচতলা থেকে ৮-১০ তলা পর্যন্ত রাসায়নিকের গুদাম ও নানা ধরনের কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। ভবনের একটি কারখানা বা গুদামে আগুন লাগলে পুরো বাড়িসহ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বিস্তৃত ধ্বংস ও মৃত্যুর মহাবিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। গত কয়েক বছরে ঢাকায় অনেকগুলো ছোট-বড় অগ্নিকা-ের ঘটনার পরও আমাদের অগ্নিনিবার্পণ ব্যবস্থা এবং জনসচেতনতায় তেমন পরিবর্তন ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ২০১০ সালে নিমতলি ট্রাজেডি, ২০১২ সালে তাজরিন গার্মেন্টস ট্রাজেডি, রানাপ্লাজা ট্রাজেডির পর আরো অনেকগুলো বড় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকা- পর্যন্ত প্রতিটা ঘটনার পরই ফায়ার সার্ভিসের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার খতিয়ান বেরিয়ে এসেছে। চোখের সামনেই শত শত মানুষের জীবন ও সর্বস্ব হারানোর আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছে।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজধানী শহরের শতকরা ৯৯ শতাংশ মার্কেট ও বাণিজ্যিক ভবনই অগ্নিকা-ের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তা আইন(২০০৩) অনুযায়ী প্রতিটি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ৩০টি অত্যাবশ্যকীয় নিয়ম অনুসরণ করে ভবন নির্মাণের কথা থাকলেও ৯৯ শতাংশ ভবনই নির্মিত হয়েছে এসব নীতিমালা অগ্রাহ্য করে। অগ্নি আইন অনুসারে বিদ্যুৎ নিরাপত্তা এবং আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভে ৫০ হাজার গ্যালন এবং ওভারহেড ট্যাংকে ১০ হাজার গ্যালন পানি মজুদ রাখার নির্দেশনা পালন করা হলে কাওরান বাজারের ওয়াসা ভবন, পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি মল বা গুলশান ডিএনসিসি ভবনে অগ্নিকা-ে এত ক্ষয়ক্ষতি হত না। এমনকি বাস্তু পরিকল্পনার সাধারণ নীতিমালা বা রাজউকের নির্ধারিত নীতিমালাও অনুসরণ করা হয় না। ভবন মালিকরা নীতিমালা অনুসরণ করছে না। এর জন্য তাদের কখনো জবাবদিহিতা করতে হয় না বলেই নতুন নতুন মার্কেট ও বাণিজ্যিক ভবনও গড়ে উঠছে অপরিকল্পিতভাবেই। তবে পুরান ঢাকার বাস্তু ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও আপদকালিন উদ্ধার তৎপরতার হ-য-ব-র-ল অবস্থা অনেক আগেই সীমা অতিক্রম করেছে। হাজারিবাগের টেনারিশিল্প, লালবাগ-চকবাজার-বংশালের কেমিক্যাল গুদাম এখন নাগরিক সমাজের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারি, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের নিয়ামক এসব গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নিয়ে আধুনিক নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধাসম্বলিত স্থানে পুনর্বাসিত করার জরুরী উদ্যোগ নিতে হবে। দেশবাসি আরেকটি তাজরিন, রানাপ্লাজা বা নিমতলি ট্রাজেডি দেখতে প্রস্তুত নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন