গ্লোবাল ইনডেক্স (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের বিষয়টি এখন সারাবিশ্বেই বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রত্যেক দেশই তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণকারী পণ্যের স্বত্ব সংরক্ষণে তৎপর। এসব পণ্য তার নিজস্ব এবং বিশ্বের আর কোনো দেশ এর স্বত্ব দাবি করতে পারে না। যাকে বলে স্বত্বাধিকারী। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডাব্লিউআইপিও) এ স্বত্ব প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশ প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন সনদ পেয়েছে জামদানি শাড়ি। এ শাড়ির স্বত্ব নিয়ে নিয়েছিল ভারত। পরবর্তীতে বাংলাদেশ আইনি লড়াই চালিয়ে এ স্বত্ব পায়। এবার জিআই পণ্য হিসেবে বাংলাদেশ ঐতিহ্যবাহী ৯৫টি পণ্যের জিআই স্বত্ব পেতে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রাজশাহী সিল্ক, কুমিল্লার রসমালাই, যশোরের খেজুরগুড়, মেহেরপুরের সাবিত্রী মিষ্টি, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, বগুড়ার নকশিকাঁথা, বাগেরহাটের চিংড়ি উল্লেখযোগ্য। জিআই পণ্য হিসেবে নির্বাচনের পর এগুলোর মালিকানা স্বত্ব পাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশ এসব পণ্য একই নামে বা একই জাতীয় পণ্যের নামে মালিকানা দাবি করতে পারবে না। এর ফলে দেশে-বিদেশে এসব পণ্য নিয়ে সব ধরনের ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থ ও সুনামের দাবিদার হবে বাংলাদেশ। উল্লেখিত পণ্যগুলোর জিআই সনদ পেতে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) রেজিস্ট্রারকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি এসব পণ্যের জিআই সনদ পাওয়ার উপযুক্ততা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। জিআই পণ্যের সনদ পাওয়ার বিষয়টি যেমন বিশ্ব দরবারে সম্মান অর্জনের ক্ষেত্র, তেমনি ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ারও একটি বড় সুযোগ।
জিআই পণ্যের সনদ পেতে হলে পণ্যটি কোন এলাকায় সহজে পাওয়া যায়, এর পেছনে ঐ এলাকার কি কি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, পণ্যের বিশেষত্ব কি, উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট এলাকার জলবায়ু, মাটি ও পানি কতটা উপযোগী, ঐ এলাকার কাছাকাছি কোনো নদী বা সমুদ্র আছে কিনা, কোনো জনগোষ্ঠী পণ্যটির উপর নির্ভরশীল বা তাদের একমাত্র আয়ের উৎস কিনা, তারা কত সময় ধরে এ পণ্য থেকে কি পরিমাণ আয় করছেÑ এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। এসব শর্ত বিবেচনা শেষে যাচাই-বাছাই করে ডিপিডিটি ৯৫টি পণ্যের মেধাস্বত্ব দাবি করতে পারে বলে এবং মালিকানা পেতে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত আনন্দের খবর। এসব পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে এগুলোর প্রতি যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে, তেমনি রফতানিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। এগুলো একেকটি রফতানি খাত হিসেবে গড়ে উঠবে। আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে আলাদা স্তম্ভ হয়ে উঠবে। বলা বাহুল্য, আমাদের এমন সব প্রাকৃতিক ও উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী রয়েছে, যেগুলোর ইতিহাস এবং ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। এসব পণ্যের দাবিদার একমাত্র আমরাই। এগুলো আমাদের নিজস্ব সম্পদ এবং তা নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা থাকে না। তবে এখন অর্থনীতির যুগে এসব ঐতিহাসিক পণ্য বিভিন্ন দেশ উৎপাদন করে মেধাস্বত্ব নেয়ার চেষ্টা করছে। যেমন, যে জামদানি একান্তই আমাদের নিজস্ব সম্পদ এবং ঐতিহ্য, তা ভারত তার বলে নিয়ে নিয়েছিল। তারপরও তার অন্ধ্র প্রদেশে উপাধ্যায় জামদানি নামে একটি নিবন্ধন নিয়ে নিয়েছে। এর আগেও যথাযথ উদ্যোগ না নেয়ায় বিভিন্ন সময়ে আমাদের কিছু ঐতিহ্যবাহী পণ্যের জিআই সনদ অন্য দেশ নিয়ে গেছে বা নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। এটা আমাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। আমাদের দেশের পণ্য অন্য দেশের হয়ে যাবে এবং তারা রফতানি করে ব্যবসা করবে, তা মোটেও হতে দেয়া যায় না। বিষয়টি সরকার যথাযথভাবে উপলব্ধি করেছে এবং আমাদের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক নিবন্ধন নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। জিআই সনদের জন্য আমাদের আরও ঐতিহ্যবাহী পণ্য রয়েছে। সেগুলোরও জিআই সনদ লাভের জন্য বিবেচনায় নিতে হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচা গোল্লা, যশোরের নকশিকাঁথা, রংপুরের শতরঞ্জি ও হাঁড়িভাঙা আম, দিনাজপুরো কাটারিভোগ চাল, রাঙামাটির হস্তজাত শিল্প, পোড়াবাড়ির চমচম, বরিশালের আমড়া, খুলনার পান-সুপারির মতো অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী পণ্য। আমাদের ঐতিহ্যবাহী এসব পণ্যকে জিআই সনদভুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে।
জিআই সনদভুক্ত হলে একদিকে যেমন আমাদের ঐতিহ্যম-িত পণ্য ভিনদেশিদের হাত থেকে রক্ষা পাবে, তেমনি সারা বিশ্বে এদের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্বের মানুষ আমাদের বিশেষায়িত পণ্য সম্পর্কে জানতে পারবে এবং তারা আগ্রহী হয়ে উঠবে। এতে অর্থনৈতিকভাবেও আমরা লাভবান হবো। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়া দেশগুলো তাদের দেশের ঐতিহাসিক মর্যাদা সম্পন্ন পণ্য নিয়ে হাজির হচ্ছে। এসব পণ্যের যেমন চাহিদা বাড়ছে, তেমনি রফতানি করেও তারা লাভবান হচ্ছে। আমাদেরও এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আমরা মনে করি, জিআই স্বত্ব লাভের মাধ্যমে অফুরন্ত সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নতুন নতুন দুয়ার খুলতে শুরু করবে। অর্থনৈতিক এ সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে কাজে লাগাতে হবে। জিআই সনদ পাওয়ার পাশাপাশি এগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি ও রফতানি উপযোগী করে তুলতে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। জিআই সনদ লাভের সরকারের এই উদ্যোগকে আমরা তাকে স্বাগত জানাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন