শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এ ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক

| প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সমাজে কোন শৃঙ্খলা, নিয়ম-নীতি রয়েছে কিনা অথবা এসবের কোন তোয়াক্কা কেউ করছে কি না সে প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সমাজের ভবিষ্যৎ বলে পরিচিত তরুণ সমাজের মধ্যে অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তার আরো একটি নজির স্থাপিত হয়েছে। গতকাল রবিবারের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বরিশাল নগরের একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান হৃদয় সকালে দাঁড়িয়েছিল স্কুল মাঠে। কথা আছে বলে সেখান থেকে তাকে ডেকে নেয় কয়েকজন তরুণ। একটু দূরে নিয়ে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করা হয় তাকে। এ দৃশ্য দেখে এগিয়ে যায় তার একজন সহপাঠী। তাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। দু’জনকে উদ্ধার করে বরিশাল শের-এ-বাংলা মেডিকেলে নিয়ে গেলে হৃদয়কে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। ঘটনা সম্পর্কে হৃদয়ের সহপাঠী, শিক্ষক ও কয়েকজন অভিভাবক জানিয়েছেন, আরেক শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় হৃদয়ের সঙ্গে সম্প্রতি কয়েকজন বখাটের বাক-বিত-া হয়। এর জের ধরেই এই খুনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে তারা সন্দেহ করছেন। এ ঘটনা সম্পর্কে একটি দৈনিককে বরিশালের নাগরিক কমিটির সভাপতি শিক্ষাবিদ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, সামাজিক অবক্ষয় অস্থিরতা ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না থাকাতেই এধরনের ঘটনা বাড়ছে। তিনি মনে করেন বর্তমানে কিশোরদের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নেই বললেই চলে। কিশোরদের এ ধরনের অপরাধে জড়ানো অশনিসংকেত বলেও তিনি মনে করেন।
গত কিছু দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বরিশালেই গত ছয় মাসে কিশোরদের দ্বারা অপরাধমূলক প্রায় ১৫টি ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় এধরনের ঘটনায় খুনের ঘটনা এই প্রথম। কিছুদিন আগে রাজধানীতে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় দু’বোন বখাটের দ্বারা আক্রান্ত হয়। তাদের অবস্থ্ াএতটাই গুরুতর ছিল যে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এর আগে উত্তরায় গ্যাংস্টার নামে তরুণদের সংগঠনের হাতে অন্য এক তরুণকে নিহত হতে হয়। কয়েক মাস আগে ফরিদপুরে মোটর সাইকেলের টাকা দিতে না পারায় পিতাকে হত্যা করে পুত্র। বলা হচ্ছে, চুরি-ছিনতাই বা ঘর পালানোর মতো অপরাধ পেছনে ফেলে কিশোরদের খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলায় আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামী। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশিরভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা। কিশোর অপরাধ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব কিশোরের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যেমনি আছে, তেমনি রয়েছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানও। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। বিদ্যমান অবস্থা বিশ্লেষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল মনে করেন, বস্তিবাসী ও নিম্নআয়ের পরিবারের কিশোররা দারিদ্র্যের কারণে, মফস্বল থেকে বড় শহরে আসা কিশোররা সমাজে টিকে থাকার জন্য এবং উচ্চবিত্তের পরিবারের সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও তথ্য-প্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধপ্রবণ করার অন্যতম কারণ। মনোচিকিৎসক অধ্যাপক তাজুল ইসলাম মনে করেন, কিশোররা ইন্টারনেটে সংযোগসহ মুঠোফোন ব্যবহার করছে। তারা যা দেখছে বাস্তবে তা ঘটিয়ে বসছে। অভিভাবক পিতা-মাতার এক ধরনের অবহেলা দায়িত্বহীনতা সমাজকে যে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে তারই চিত্র উঠে এসেছে। পারিবারিক ও সামাজিক নীতি-নৈতিকতার যে চরম অবক্ষয় ঘটছে তারই ধারাবাহিকতায় এ ধরনের অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে চলেছে।
নীতি-নৈতিকতা বর্জিত হবার খেসারতই এখন দিচ্ছে সমাজ। বলার অপেক্ষা রাখে না, তরুণদের বিপথগামী হওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায় রয়েছে। সন্তান কোথায় যায়, কী করে, এ খোঁজ অনেক অভিভাবকই নেন না। ফলে সন্তানরা বিপথগামী হয়ে উঠছে। একের পর এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। অভিভাবকদের এ ধরনের উদাসীনতা শুধু তাদেরকেই নয় গোটা পরিবার ও সমাজকে অনিরাপদ করে তুলছে। তারা যদি সচেতন না হন তবে তাদের যেমন ভুগতে হবে, তেমনি সমাজকেও মাসুল গুনতে হবে। এ প্রবণতা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তরুণরাই ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারাই আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তরুণরা যদি বিপথগামী হয়ে পড়ে তবে দেশ এক মহাসংকটে পড়বে। একের পর এক কিশোর-তরুণদের দ্বারা যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে তা প্রতিরোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিভাবকদের সন্তানের প্রতি যতœবান হওয়ার পাশাপাশি পারিবারিক শাসন-বারণ ব্যবস্থার মধ্যে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সন্তান শুধু পরিবারেরই সম্পদ নয়, দেশেরও সম্পদ। কাজেই পরিবার থেকেই সন্তানকে সঠিকপথে পারিচালনা করতে হবে। এ ব্যাপারে উদাসীন হলে চলবে না। কেবলমাত্র সাজার দ্বারা এসব অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। সমাজবৃত্তে মূল্যবোধের উজ্জীবন ঘটাতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন