রাজধানী ঢাকা এখন ধুলায় ধূসরিত। রাত বা দিন বলে কথা নেই, সব সময়ই ধুলা উড়ছে। গোটা রাজধানীর দৃশ্যপট দেখলে মনে হয়, সবকিছু ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে। ধুলার অত্যাচারে পথচারীরা অতিষ্ঠ। গৃহেও কারো স্বস্তি নেই। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর-সব ধুলি মলিন ধুলা নির্বিবাদে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করছে। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাসহ নানা রোগ-ব্যাধি দেখা দিচ্ছে। ধুলা খোলা হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের সঙ্গে মিশছে। তা খাওয়ার পর বিভিন্ন সমস্যা ও রোগ দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থাকে ভয়াবহ বললেও কম বলা হয়। নগর কর্তৃপক্ষ ও অন্য কারো এদিকে নজর নেই। মানুষ নিরুপায়; তাদের কিছু করার নেই। নীরবে ধুলার উপদ্রব তাদের সহ্য করতে হচ্ছে, এর ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন সেবা সংস্থার উন্নয়নমূলক কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ ওই ধুলার উৎস এবং তার বিস্তারের কারণ। বিশেষ করে মগবাজার-মালিবাগ এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণের যে কাজ চলছে, দীর্ঘদিন তা সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের অসুবিধা ও অস্বস্তির কারণ হয়ে রয়েছে। সব দেশের রাজধানীতেই প্রয়োজনে উন্নয়ন ও নির্মাণকাজ চলে, সেবা সম্প্রসারণের কাজ হয়, সংস্কারের কাজও হয়। কিন্তু কোথাও এ ধরনের অবস্থা দেখা দেয় বলে আমাদের জানা নেই। এ দেশে নাগরিকদের যে মানুষ বলে মনে করা হয় না, এটা তার একটা বড় প্রমাণ। খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ-সংস্কার কাজে যে ধুলার সৃষ্টি হয়, তা দূর করার জন্য নিয়মিত পানি ছিটানোর কথা থাকলেও তা করা হয় না। কেন করা হয় না, তার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। দায়িত্বহীনতা ও অবহেলাই এর একমাত্র কারণ। এর ফলে নাগরিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে, চিকিৎসায় অর্থ ব্যয় করছে। মানুষের সমূহ ক্ষতি হলেও লাভ হচ্ছে হাসপাতাল ও ডাক্তারদের।
বায়ুদূষণ রাজধানীর একটা বড় সমস্যা। বলা হয়, এখানে নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষ প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণ করছে। সেই বিষাক্ত বায়ুর সঙ্গে উত্তপ্ত ধুলার মিশ্রণ বায়ুকে রীতিমতো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। সংস্থাটি ৯১টি দেশের শহরের মধ্যে যে ২৫টি শহরকে সবচেয়ে বেশি দূষিত শহর বলে চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশেরই রয়েছে তিনটি শহর। এগুলো হলো: ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর। বায়ুদূষনজনিত কারণে মৃত্যুর দিক দিয়েও বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ চারে। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত রোগ-ব্যাধিতে বছরে ৯২ হাজার লোক মারা যায়। ঢাকা শহরে মারা যায় ১৩ হাজার ১০০ জন। বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকার বাতাসে সূক্ষè বস্তুকণা, লেডের মতো ভারী বস্তুকণাসহ নাইট্রোজেন অক্সসাইড, কাবর্ণ মনোঅক্সসাইড, সালফার অক্সাইড মার্কারি ইত্যাদির মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এই অগ্রহণযোগ্য ও দূষিত বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করার ফলে মানুষ ব্যাপক হারে ব্রঙ্কাইটস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রদাহ, চোখের রোগ, হৃদরোগ ও যকৃতের সমস্যার শিকার হচ্ছে। এসব রোগের চিকিৎসায় মোটা অংকের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। চিকিৎসায় অযোগ্য হয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে। বস্তুত, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ এবং ময়লা-আবর্জনার সয়লাবের কারণে রাজধানী মানব বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বিদ্যমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে এমন একটা সময় আসতে পারে যখন এই নগরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। অপরিকল্পিত নগরায়নে রাজধানী অনেক আগেই ‘ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায়’ পরিণত হয়েছে। এক সময় এটি ছিল গ্রিন সিটি। সেই সেই সবুজ, সেই গাছপালা, সেই উন্মুক্ত স্থান, সেই প্রবহমান নদী-খালÑ কোনো কিছুরই এখন অস্তিত্ব নেই। পরিবেশের অবিশ্বাস্য অবনমন, সর্বমুখী দূষণের বিস্তার, ভয়াবহ যানজট, বিপুল সংখ্যক মানুষের কেন্দ্রীভবন ইত্যাদি এই নগরকে ক্রমাগত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার উত্তোরণে না সরকারের কোনো বড় উদ্যোগ আছে, না আছে নগর কর্তৃপক্ষের কোনো উদ্যোগ। সরকারের তরফে রাজধানীকে তিলোত্তমা করার কথা শুনতে শুনতে নগরবাসী বিরক্ত। এখন নগর কর্তৃপক্ষের দিক থেকে গ্রিন সিটি করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কোথায় সেই পরিকল্পনা ও উদ্যোগ? যেসব উদ্যোগ-পরিকল্পনার কথা শোনা গেছে তা এখনো কথার মধ্যেই সীমিত হয়ে আছে। যেখানে ধুলার উপদ্রব থেকে রক্ষারই কোনো ব্যবস্থা করা হয় না, সেখানে আর কী হবে! বলাই বাহুল্য, এ অবস্থা কোনো বিবেচনাতেই চলতে পারে না। রাজধানীকে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যসম্মত ও বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ মুহূর্তে ধুলার জুলুম থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে হবে। নিয়মিত পানি ছিটিয়ে ধুলা নিবারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন