চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা স্থানীয় নীলকমল ওছমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ছাত্ররা একটি মানবসেতু তৈরী করে এবং উপজেলা চেয়ারম্যান অন্য ছাত্রদের হাতের উপর শুয়ে থাকা স্কুল ছাত্রের পিঠের উপর দিয়ে জুতা পায়ে হেঁটে যান। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ছবিটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং একজন জনপ্রতিনিধির এ ধরনের অমানবিক ও ন্যক্কারজনক কাজের বিরুদ্ধে একযোগে ধিক্কার উঠেছে। কোন কোন গণমাধ্যম ঘটনাটিকে ‘জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের বুকের উপর হেঁটে যাওয়া’ বলে মন্তব্য করেছে। বিষয়টি অন্যকোন সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের মধ্যে ঘটলে সম্ভবত এতটা আলোচিত-সমালোচিত হতনা। ওরা তো শিশু-কিশোর, কোমলমতি স্কুলছাত্র। উপলক্ষ যা-ই হোক, একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে শিশুদের পিঠের উপর হেঁটে বেড়ানোর এই দৃশ্য প্রকৃত অর্থেই অরুচিকর ও অমানবিক। এই ঘটনার মধ্যে উক্ত জনপ্রতিনিধির শিক্ষা, রুচি ও মানবিক মূল্যবোধ যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, একইভাবে এই একটি ঘটনা আবারো আমাদের সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বৃত্তপনা ও বেপরোয়া মনোভাবকেই সুস্পষ্ট করে।
একের পর এক ভোটারবিহীন, একতরফা ও দখলবাজির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারবাহিকতায় পরবর্তী প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনই ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন ব্যবস্থার চরম বরখেলাফ। এসব নির্বাচনের মধ্যদিয়ে সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি হিসেবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই বেপরোয়া দুর্বৃত্তপনা, সন্ত্রাস, লুটপাট, মাদক ব্যবসা এবং জনপীড়নমূলক কর্মকা-ের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি তাদের লাইসেন্সকৃত অস্ত্রে শিশু ও নিরীহ মানুষের উপর গুলি চালানোর ঘটনাও জাতি দেখেছে। অনেক এলাকাতেই তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা সর্বময় কর্তৃত্ব ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, সুসভ্য সমাজে জনপ্রতিনিধিদের এমন বেপরোয়া আচরণ ও কর্মকা-ের নজির আছে কিনা আমাদের জানা নেই।
আমাদের সমাজ একটি চরম অবক্ষয়ের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। শিক্ষার মানহীনতা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের মন ও মননশীলতাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। শহর-বন্দরের শিশু-কিশোরদের একটি অংশ সহিংসতা ও গ্যাংস্টার সংস্কৃতিতে জড়িয়ে নৃশংস ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এমতাবস্থায় নাগরিক সমাজ, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন ও অভিভাবক মহলকে নিজ নিজ সন্তান, পোষ্য ও শিক্ষার্থীসহ আগামী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকা-ে সক্রিয় পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষত, সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে মানুষ আরো মানবিক, সৃজনশীল ও গঠনমূলক ভূমিকা আশা করে। যে জনপ্রতিনিধি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে সম্বর্ধনা গ্রহণ করেন, শিশুদের সামনে ধূমপান করেন অথবা শিশু-কিশোরদের ওপর দিয়ে জুতা পায়ে হেঁটে যেতে কুণ্ঠিত হন না, তাদের কাছ থেকে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করা যায় না। আগে তাদের নৈতিক চরিত্র ও রুচিবোধের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। এ কথা নিশ্চিত যে, দেশে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী সংস্কৃতি থাকলে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে অপেক্ষাকৃত ভাল লোকদের বেছে নিতে পারতো। মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ, সন্ত্রাস ও মাদকের সর্বগ্রাসী ছোবল থেকে এ সমাজকে রক্ষা করতে হলে সমাজে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বেপরোয়া কর্মকা-ের কারণে নানা ধরনের সমস্যার কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছিলেন ডিসিরা। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বেপরোয়া আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদের তালিকা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন। তবে অদ্যাবধি সেই তালিকা হয়েছে কিনা বা তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা আমাদের তা’ জানা নেই। অমানবিক বেপরোয়া জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান করা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বিরত থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন