গ্রিন টি মুখের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে সম্প্রতি ‘ক্যান্সার প্রিভেনশন রিসার্চ’ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়,
গ্রিন টি মুখের ক্ষত, যা পরবর্তী সময়ে ক্যান্সারে পরিণত হয়, তা থেকে মুখকে রক্ষা করতে পারে। ৪১ জন রোগীর ওপর একটি পরীক্ষা করা হয়, যাদের প্রত্যেকের মুখে প্রিম্যালিগন্যান্ট (ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে এমন) ক্ষত আছে। এদেরকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে ভিন্ন ঘনত্বের গ্রিন টির নির্যাস খেতে দেয়া হয় দিনে তিনবার ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত। পরীক্ষা শেষে দেখা যায়, যাদের বেশি ঘনত্বের গ্রিন টির নির্যাস দেয়া হয়েছিল তাদের মুখের ক্ষত ৫৮.৮% ভালো হয়েছে এবং পুরনো ক্ষত আর বৃদ্ধি পায়নি। যারা কম ঘনত্বের নির্যাস গ্রহণ করেছে তাদের ৩৬.৪% ক্ষত প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে এবং পাসিবো বা কিছুই দেয়া হয়নি যাদের তাদের ১৮.২% উন্নতি হয়েছে।
মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধে গ্রিন টির এটিই প্রথম পরীক্ষা, যা থেকে মুখের ক্ষত প্রতিরোধ করার প্রমাণ পাওয়া যায়। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে গ্রিন টির ক্যান্সার রোধ করার ক্ষমতা আরো গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত হবে।
সয়াবিন ও হলুদ প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সার প্রতিরোধ করে অতি সম্প্রতি আমেরিকার একদল গবেষক সয়াবিনে বিদ্যমান সয়া আইসোফ্যাভোন ও হলুদে বিদ্যমান কুরকুমিনের প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সারের অবস্থান চতুর্থ। আর তাই এর ভয়াবহতা রোধ খুবই জরুরি। বিজ্ঞানীরা বলেন, সয়াবিনে বিদ্যমান সয়া আইসোফ্যাভোন ও হলুদে বিদ্যমান কুরকুমিন যৌথভাবে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী জিনের কার্যকারিতা বন্ধ করার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।
আমেরিকার ওই গবেষকদল প্রথমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশে প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাবের ওপর তথ্য সংগ্রহ করেন। তারা লক্ষ্য করেন, এশিয়া মহাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে এই ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব কম এবং পাশাপাশি তারা এ বিষয়টিও লক্ষ্য করেন যে এ মহাদেশের লোকজন সয়াবিন ও হলুদ বেশি পরিমাণে গ্রহণ করে থাকে। আর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গবেষকরা ধারণা করেন যে, সম্ভবত অধিক সয়াবিন ও হলুদ গ্রহণই এশিয়ানদের মধ্যে প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সার কম হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। আর এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গবেষকরা তাদের গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন। তারা গবেষণাগারে চাষ (কালচার) করা ক্যান্সার কোষের ওপর সয়াবিন থেকে পাওয়া সয়া আইসোফ্যাভোন ও হলুদ থেকে পাওয়া কুরকুমিন যৌথ ও আলাদা আলাদাভাবে প্রয়োগ করেন। তারা দেখতে পান, ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ ও স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটাতে (অঢ়ড়ঢ়ঃড়ংরং) সয়া আইসোফ্যাভোন ও কুরকুমিনের যৌথ প্রয়োগ আলাদা আলাদা প্রয়োগ করা অপেক্ষা অনেক বেশি কার্যকর।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সয়াবিনে বিদ্যমান সয়া আইসোফ্যাভোন ও হলুদে বিদ্যমান কুরকুমিন ক্যান্সার সৃষ্টিকারী নিউকিয়ার ফ্যাক্টর কাপ্পা বি (ঘঋ-কই)-এর কার্যকারিতা বন্ধ করার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। তাই প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সার প্রতিরোধে আমাদের সয়াবিন দিয়ে তৈরি খাবার ও কুরকুমিন-সমৃদ্ধ হলুদ খাওয়া উচিত। আমরা যদি প্রতিদিন অল্প পমিাণ কাঁচা হলুদ খাই তবে তা হতে পারে প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সারসহ সব ধরনের ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগ প্রতিরোধের এক অনন্য হাতিয়ার।
সব প্রকার কপিজাতীয় সবজি প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক প্রোস্টেট ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তারের ওপর পরিচালিত এক গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গবেষকরা বলেন, কেউ যদি নিয়মিতভাবে সপ্তাহে অন্তত এক বেলা কপিজাতীয় সবজি (ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি) খায়, তবে তার প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পাবে। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে কালচার (চাষ) করা প্রোস্টেট ক্যান্সার কোষের ওপর এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত বিভিন্ন প্রাণীদেহে কপিজাতীয় সবজির নির্যাস প্রয়োগ করার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, কপিজাতীয় সবজিতে বিদ্যমান আইসোথায়োসায়ানেট নামে জৈব রাসায়নিক উপাদানটি প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিককালে গবেষকেরা দীর্ঘ এক বছর ধরে মানব দেহেও কপিজাতীয় সবজির প্রোস্টেট ক্যান্সার-প্রতিরোধী কার্যকারিতার ওপর এক গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন।
এ গবেষণার প্রথম ধাপে কিছু লোককে (পুরুষ) দুটি দলে ভাগ করেন। এক দলকে কপিজাতীয় খাবার খেতে দেন এবং অপর দলকে মটরসমৃদ্ধ খাবার খেতে দেন। এই গবেষণা এক বছর সময় নিয়ে পরিচালিত হয়। এ গবেষণার শুরুতে, গবেষণা চলাকালীন সময় এবং গবেষণার শেষে সবার প্রোস্টেটের বায়োপসি করা হয় এবং তাদের প্রোস্টেটে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী জিনের কার্যকারিতা দেখা হয়। গবেষকরা এ গবেষণায় দেখতে পান যে, যারা নিয়মিত কপিজাতীয় খাবার গ্রহণ কেরছিলেন তাদের প্রোস্টেট ক্যান্সার ও প্রদাহ সৃষ্টিকারী জিনের কার্যকারিতার তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল, যা প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
এ গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গবেষকরা বলেন, যারা নিয়মিত কপিজাতীয় সবজি খাবে তাদের প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পাবে।
ব্রকলি ব্রেস্ট ক্যান্সারের স্টেম সেলের বৃদ্ধি রোধ করে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, সালফোরাফেন নামে একটি যৌগ, যা ব্রকলি এবং ব্রকলি স্প্রাউটে পাওয়া যায়। এই যৌগ ক্যান্সার স্টেম সেল ধ্বংস করতে পারে। কেমোথেরাপির সাহায্যে যেসব ক্যান্সার স্টেম সেল ধ্বংস হয় না, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য একটি ব্যাপার হলো, ব্রকলি সালফোরাফেন ব্রেস্ট ক্যান্সার সেলের পুনরুৎপাদন, বৃদ্ধি ও বিস্তার রোধ করতে পারে।
ডুক্সিন সুন, পিএইচডি এবং তার সহকর্মীরা ব্রকলির নির্যাস সালফেরাফেনের বিভিন্ন মাত্রার ইনজেকশন পুশ করেন মানুষের ব্রেস্ট ক্যান্সার টিউমার সেল সংযুক্ত ইঁদুরদের।
পরীক্ষা শেষে দেখা যায়, টিউমারের স্টেম সেলের বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং স্বাভাবিক সেল কোনো রকম আক্রান্ত হয়নি। আরো দেখা যায়, ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রাণী যারা সালফোরাফেন গ্রহণ করেছে, তাদের কোষ নিয়ে অন্য সুস্থ প্রাণীকে আক্রান্ত করার পরে তাদের দেহে টিউমার সেল বৃদ্ধি পায়নি।
অতীতের গবেষণা থেকে ক্যান্সারের ওপর সালফোরাফেনের প্রভাব সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু এই নতুন গবেষণা থেকে দেখা যায়, ব্রেস্ট ক্যান্সার স্টেম সেলের বৃদ্ধিকে সালফোরাফেন বাধা দেয়।
ষ ডা. আলমগীর মতি
লেখক : বিশিষ্ট হারবাল গবেষক ও চিকিৎসক
ফোন : ০১৯১১৩৮৬৬১৭
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন