নিজভূমে পরবাসী ফিলিস্তিনীদের মুক্তি এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে জোরালো সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও তার প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ৩ দিনের সফরে এসে ঢাকায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনের সংকটময় মুহূর্তে মাহমুদ আব্বাসকে বাংলাদেশে স্বাগত জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ। প্রেসিডেন্ট মোঃ আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বৈঠকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও দুই জাতি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রশ্নে বাংলাদেশ তার অটুট অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। পাশাপাশি দুই রাষ্ট্রের মধ্যে আরো নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে যৌথ কমিটি গঠনে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছেন। ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিদল এমন সময় এ সফর করছে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের বৈরী একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর জায়নবাদী ইসরাইল চরম আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ঘোলাটে পরিস্থিতির সুযোগে, জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের নিন্দা ও বিরোধিতা উপেক্ষা করে ইসরাইল পশ্চিমতীরের দখলিকৃত ভূমিতে নতুন করে হাজার হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলের এ ধরনের পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনায় বিশ্বসম্প্রদায়ের উদ্যোগকে সংকটাপন্ন করে তুলতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এহেন বাস্তবতায় দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রশ্নে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালো সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করার বিষয়টি ফিলিস্তিনীদের বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সুদীর্ঘ ইতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনীদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানিয়ে আসছে। এমনকি বিভিন্ন সময়ে ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এদেশের অনেক তরুণ ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়াইয়েও যোগ দিয়েছেন। গত সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশে নানা রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন ঘটলেও ফিলিস্তিনীদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি জনগণ ও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কোন পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর কঠিন সময়ে যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিলিস্তিনীদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, একই ভাবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে আজকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও ফিলিস্তিনের প্রতি ধারাবাহিক ও অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রেখে ফিলিস্তিনি সংহতির প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও ঐক্যের ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখেছেন। সম্পর্ক আরো জোরদার করার ক্ষেত্রে মাহমুদ আব্বাসের এই সফর ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। যতই দিন যাচ্ছে জায়নবাদী ইসরাইলীদের ষড়যন্ত্র ও কুপ্রভাব ছিন্ন করেই ফিলিস্তিনীদের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের সমর্থন বাড়ছে এবং জোরালো হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় অচিরেই একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটবে বলে আমরা আশাবাদী।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় ইসরাইলের যুদ্ধবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কিছুটা চাপের মধ্যে থাকলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ইসরাইলের সুর ও গতিবিধি অনেকটাই পাল্টে যেতে শুরু করেছে। অবশ্য গত কয়েক মাসে বিশ্বসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে বেশকিছু অগ্রগতিও অর্জিত হয়েছে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পূর্ব জেরুজালেমের উপর ইহুদীদের অধিকারের প্রশ্নে মুসলমানদের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় ঘোষিত হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলনসহ ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার কয়েকটি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপে সিরিয়া ও ইরাকে পশ্চিমা বশংবদ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর জায়নবাদী ইসরাইল পরোক্ষভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে আরব দেশগুলোর অনৈক্য ও অস্বচ্ছ ভূমিকার সুযোগ নিচ্ছে ইসরাইল। এখন জাতিসংঘের রুলিং এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশন লঙ্ঘন করেই ইসরাইল পশ্চিমতীরে আরো ইহুদি বসতি স্থাপনের পাঁয়তারা করছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টকে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। আরব-ইসরাইলের পুরনো বিরোধ মীমাংসায় দ্বি-জাতিভিত্তিক সমাধানের বাইরে আর কোন সমাধান নেই। পূর্ব জেরুজালেমের উপর ইসরাইলীদের অবৈধ ও অন্যায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করে ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমান্তরেখা অক্ষুণœ রেখে জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বশান্তির জন্য এখন অপরিহার্য। এ বাস্তবতা অস্বীকার করা মানে মধ্যপ্রাচ্যকে আরো অনির্দিষ্টকাল সহিংস যুদ্ধের মধ্যে রেখে দেয়া। ফিলিস্তিনে ইসরাইলী দখলদারিত্বের পর গত ৭ দশকে বিশ্বের হিসাব-নিকাশ অনেকটাই পাল্টে গেছে। সিরিয়ার সাম্প্রতিক বাস্তবতার কথা বাদ দিলেও এক সময়ের অজেয় ইসরাইলী সেনাবাহিনী গত কয়েক বছরে অন্তত দুইবার ফিলিস্তিনী ও লেবানিজ মিলিশিয়াদের হাতে মার খেয়ে গাজা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এসব বাস্তবতা মাথায় রেখে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে ইসরাইলকে বাধ্য করতে জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায় সম্ভাব্য সব রকম পদক্ষেপ নেবে, এই মুহূর্তে এটাই আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন