বাংলাদেশে ভয়ংকর প্রাণঘাতী রোগ ক্যান্সারে প্রতি বছর কত লোক আক্রান্ত হয় এবং কত লোক মারা যায় তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি)-এর অনুমিত হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজার লোক নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আর মারা যায় ৯১ হাজার। এই হিসাবে প্রতিদিন আক্রান্ত হয় ৩৩৪ জন এবং মারা যায় ২৫০ জন। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, এ দেশে প্রাণঘাতী রোগগুলোর মধ্যে ক্যান্সারের অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে। প্রতিদিন এই একটি মাত্র রোগে এত মানুষ আক্রান্ত ও মারা যায়, এটা অধিকাংশেরই জানা নেই এবং জানা থাকারও কথা নয়। সুতরাং এই পরিসংখ্যান অনেকের কাছেই বিস্ময়কর বলে মনে হবে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপারে এই যে, এদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত ও অপ্রতুল। বিশেষজ্ঞরা অনেকেই দাবি করেন, শুরুতে ক্যান্সার শনাক্ত করা গেলে উপযুক্ত চিকিৎসায় নিরাময় সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুযোগ এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এ দু’টিরই ঘাটতি ও অভাব রয়েছে। দেশে মাত্র নয়টি সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ ও ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে ঢাকায় আছে দু’টি এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটে একটি করে হাসপাতাল। যেসব হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ-ব্যবস্থা আছে সেসব হাসপাতালে অবকাঠামোসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির যেমন অভাব আছে, তেমনি আছে ডাক্তারের অভাব। ফলে রোগীরা এই সীমিত চিকিৎসা সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির এটি একটি বড় কারণ।
যেখানে ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ ও ব্যবস্থা আছে সেখানে রেডিও থেরাপির ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। কিন্তু অত্যন্ত দরকারী এ মেশিনের অভাব প্রচ- বললেও কম বলা হয়। বর্তমানে একমাত্র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চেই এ সুবিধাটি রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দু’টি রেডিও থেরাপি মেশিন কয়েক মাস ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট মেডিকেল কলেজেও রেডিও থেরাপি মেশিন দীর্ঘদিন ধরে সচল অবস্থায় নেই। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চে ছয়টি মেশিন আছে যার ক্যাপাসিটি দৈনিক মাত্র ৫০০। দেখা গেছে, সেখানে রেডিও থেরাপি নিতে আসা রোগীদের অন্তত হাজার খানেক চিকিৎসা না নিয়েই দৈনিক ফেরত যায়। জানা যায়, ৩০০ বেডের এই হাসপাতালে গত বছর ১২ হাজার রোগীকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়েছে। প্রায় সমসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৬০টি রেডিও থেরাপি সেন্টার আবশ্যক। সেখানে বর্তমানে একটি সরকারি হাসপাতালে ৬টি মেশিন কার্যকর অবস্থায় আছে। এতেই বুঝা যায়, সরকারিভাবে ক্যান্সার চিকিৎসা কতটা অমনোযোগ ও অবহেলার পর্যায়ে রয়েছে। জানা মতে, ১১টি বেসরকারি হাসপাতালে রেডিও থেরাপি মেশিন আছে। এসব হাসপাতালে গিয়ে রেডিও থেরাপি দেয়া ৯০ শতাংশ রোগীরই সামর্থ্য নেই। ব্যয় পাঁচ গুণেরও বেশি। অতি ভাগ্যবান ও বিত্তবান রোগী ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে রেডিও থেরাপি দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
সব শ্রেণীর লোকই ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে এবং হয়ও। পরিসংখ্যান নিলে হয়তো দেখা যাবে, ক্যান্সার আক্রান্তের মধ্যে গরীব লোকের সংখ্যাই বেশি। ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যের অভাব, দারিদ্র্য, অত্যধিক ধূমপান, পরিবেশগত বিপর্যয় ইত্যাদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। দেখা গেছে, বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও লাং ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। কেন এই দুই ধরনের ক্যান্সার বেশি, সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। ক্যান্সার চিকিৎসা একদিকে সময় সাপেক্ষ অন্যদিকে ব্যয়বহুল। দরিদ্রজনের পক্ষে এরকম দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। পরিসংখ্যানে এও হয়তো দেখা যাবে, যারা মারা যায় তাদের অধিকাংশই দরিদ্রবর্গভুক্ত। যেহেতু এই রোগটি ব্যাপকভাবে দেখা দিচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও উদ্বেগজনক, সুতরাং এ রোগের চিকিৎসায় হেলাফেলা করার কোনো অবকাশ নেই। ক্যান্সার সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা এবং সহজ ও স্বল্প মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থাই কেবল প্রাণহানির সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারে। এ জন্য ক্যান্সার চিকিৎসার সুবিধা সম্প্রসারণ ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, সরকার ক্যান্সার চিকিৎসাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসা সুবিধা ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাড়ানোর তেমন কোনো উদ্যোগ এখনো লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রতি জেলায় একটি করে আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছে। এ নির্দেশ যথাযথভাবে ও ত্বরিত কার্যকর হলে ক্যান্সার চিকিৎসায় বড় ধরনের অগ্রগতি আসবে। আমরা এই নির্দেশের আশু বাস্তবায়ন কামনা করি। এই সঙ্গে আশা করি, এ রোগ চিকিৎসায় যতটুকু সুবিধা ও ব্যবস্থা আছে তা ষোলআনা কাজে লাগানোর জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হবে। বিশেষ করে রেডিও থেরাপি সুবিধা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ক্যান্সার হাসপাতালের পাশাপাশি রেডিও থেরাপি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হলে রোগীরা অধিক সংখ্যায় সেবা-সুবিধা লাভ করতে পারবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন