শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

‘ম্যাডাম, তাজেল তো মারা গেছে’

প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. ফজলুর রহমান, হবিগঞ্জ থেকে : হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাস্টার ট্রেনিং চলছে সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সরকারি ছুটির কারণে বন্ধ ছিল গত দু’দিন।
৪র্থ শ্রেণিতে রোল কল করছিলেন শিক্ষিকা নাজমুন নাহার। রোল ৪০ তাজেল, রোল ৪০ তাজেল। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হঠাৎ একজন বলে উঠলো, ‘ম্যাডাম তাজেল তো নেই। তাজেল মারা গেছে’। প্রিয় ছাত্রের মৃত্যু প্রসঙ্গে কথা হলে শিক্ষিকা নাজমুন নাহার বলেন, ‘এ কথাটি আমার কাছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। গত সপ্তাহেও আমার সামনে বসা ছিল তাজেল। খাতায় এখনও তার নাম, রোল ও হাজিরা রয়েছে। এই খাতায় ওর নাম থাকবে এ বছর। কথা বলতে বলতে চোখ অশ্রুশিক্ত হয়ে উঠে শিক্ষিকা।
স্কুলের ১০০ মিটারের মধ্যেই কবর দেওয়া হয়েছে সুন্দ্রাটিকি হত্যাকান্ডে নিহত ৪ শিশুকে। তারা হলো- সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার চাচাতো ভাই প্রথম শ্রেণির ছাত্র মনির মিয়া (৭), চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তাজেল মিয়া (১০) ও তাজেলদের প্রতিবেশী সুন্দ্রাটিকি মাদ্রাসার ছাত্র ইসমাইল মিয়া (১০)।
শিক্ষিকা বলেন, ‘এই পথ দিয়েই আমরা প্রতিদিন স্কুলে আসি। আসার পথে নিজের ছাত্রদের কবর দেখে বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। আমরা শিক্ষকরা থাকি ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো দেখি। এটা সন্তান হারানোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়’।
২য় শ্রেণির ছাত্র শুভর রোল ছিল ‘২’। নাজমুন নাহার বলেন, ‘বেশ ভালো ছাত্র ছিল। সব কিছু একবারেই শিখতে পারতো। ‘ম্যাডাম, ম্যাডাম’ বলে এমনভাবে ডাকতো যেন এখনও শুনতে পাই তার ডাক। তার চেহারা চোখে ভাসে এখনো।
স্কুলের আরেক শিক্ষিকা নূরে জান্নাত শেফা বলেন, ‘ছোট ছোট ৪টি কবর পার হয়ে এই স্কুলে আসাটা যে কতটা বেদনার তা বোঝাতে পারবো না। নিজের ছাত্রদের কবর!’ এতো আসলে নিজের সন্তানের কবর। আমার সন্তানদের এভাবে মরতে হলো আমি তা কি করে মেনে নিব বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
শেফা জানান, এই স্কুলে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের শিক্ষার্থীইবেশি। এছাড়াও বাগানের (চা বাগান) কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে। সব শিক্ষকই সব শিক্ষার্থীদের চেনেন। স্কুলে বর্তমানে ৩৭০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও সবাই নিয়মিত নয়। যারা নিয়মিত, তাদের সঙ্গে সবারই খাতির আছে। ওই শিশুগুলো স্কুলে নিয়মিত ছাত্র ছিল। তাই তাদেরকে সবাই চিনেন।
মনির মিয়া ভর্তি হয়েছিলো এ বছরই ১ম শ্রেণিতে। ফুট ফুটে চেহারা তার। ছোট ছোট শব্দে কথা বলতো। মাত্র শুরু করেছে পড়াশোনা। এমন ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে কেউ খুন করতে পারে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় শিক্ষকদের!
দুই শিফটে এই স্কুল চলে। সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ১ম, ২য় শ্রেণি ও শিশু-১ শ্রেণি এবং ২য় শিফট দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৩য়, ৪র্থ এবং ৫ম শ্রেণির ক্লাস চলে।
সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন এই শিক্ষিকারা। নাজমুন নাহার বলেন, ‘স্থানীয় একটি দৈনিকে আমার বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, ছাত্রদের স্কুলে আসতে বাধা দেওয়া হতো। এ ধরনের কিছুই আমি বলিনি কাউকে। আমরা অন্য গ্রাম থেকে এসে শিক্ষকতা করি। এসব জানারও কথা নয়’।
অপহরণের ৫ দিন পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার সকালে গ্রামের সামান্য অদূরে ইছারবিল খালের পাশে বালু চাপা দেওয়া অবস্থায় ওই শিশুদের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
গ্রামের পঞ্চায়েতের দ্বন্দ্ব ও গাছের ডাল কাটা নিয়ে বিরোধের জের শিশুদের শ্বাসরোধে হত্যা করে ঘাতকরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন