শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সিরিয়ায় মানবিকতার বিপর্যয়

| প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সিরিয়ার একটি সামরিক কারাগারে গত পাঁচ বছরে ১৩ হাজারের মত লোককে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, প্রতি সপ্তাহে ৫০ জনের মত বন্দিকে গ্রুপে গ্রুপে এসব গণফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাজধানী দামেস্কের কাছে এই জেলখানাটি পরিচিত কসাইখানা হিসেবে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক এবং মানবাধিকারকর্মী যারা প্রেসিডেন্ট আসাদ সরকারের বিরোধিতা করেছেন। অবশ্য রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের খবর সবসময়ই অস্বীকার করে আসছে সিরিয়ার সরকার। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের রিপোর্ট তৈরি করেছে গত ছয় বছর ধরে আশিজনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। এদের মধ্যে সায়ডানায়া কারাগারের সাবেক বন্দি যেমন আছেন, তেমনি আছেন ঐ জেলখানায় রক্ষী হিসেবে কাজ করছে এমন কয়েকজন। রিপোর্টে অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করছে গণহারে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে। সংস্থাটির একজন গবেষক জানিয়েছেন, জেলখানায় যাদের রাখা হতো তাদের বেশিরভাগই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। মূলত প্রেসিডেন্ট  আসাদের বিরোধিতা করার কারণেই তাদের জেল হতো।
সিরিয়ার ঘটনাবলীর ওপর যারা নজর রাখছেন তারা অনেকদিন থেকেই একথা বলে আসছেন যে সেখানে মূলত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি দল দেশটিকে কসাইখানায় পরিণত করেছে। দেশটিতে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করলেও সেখানে যে ধরনের দমন-পীড়ন নির্যাতন-নীপিড়ন চলে আসছে তা ইতিহাসের অনেক নারকীয় ঘটনাকেও হার মানিয়েছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর গ্যাসচেম্বারে হত্যাকা-ও এখন সিরিয়ার সরকারি গণহত্যার কাছে মøান হয়ে পড়েছে। সিরিয়ার যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সরকার বিরোধীদের ধরে কারাগারে খুবই অমানবিক পরিবেশে রাখা হতো। বন্দি অবস্থায় তাদের উপর নির্যাতন চালানো হত। তাদের অনাহারে রাখা হত। চিকিৎসা দেয়া হত না এবং এদের অনেককে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সেখানে নিয়ে যাওয়ার আগে অল্প কিছুক্ষণের জন্য বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হতো একটি সামরিক আদালতে। সেখানে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ করে ফেলা হতো তাদের বিচার। সংস্থাটি বলেছে যে লোকজনদের গণহারে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে সেটা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের জ্ঞাতসারেই ঘটেছে। জেলখানার সাবেক রক্ষী এবং কর্মকর্তাদের দেয়া বিবরণ অনুযায়ী, সিরিয়ার সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানেই এই গণফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক মানদ-ের কিছুই এসব আদালতে মানা হয়নি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফাঁসি কার্যকর করার দিনে সংশ্লিষ্টদের বলা হতো তাদের বেসামরিক কারাগারে স্থানান্তর করা হবে। এইকথা বলে বন্দিদের ভূগর্ভস্থ সেলে নেয়া হতো এবং সেখানে দুই থেকে তিন ঘণ্টা পেটানো হতো। মধ্যরাতে বন্দিদের চোখবেঁধে কারাগারের অন্য অংশে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষে নিয়ে বন্দিদের ফাঁসিতে ঝোলানো হতো। সিরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অধীনে চলে এসব আদালত এবং এরা কি করছে তা অবশ্যই প্রেসিডেন্টের কাছে পরবর্তীতে জানানো হয়। এভাবে যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাদের দেহ ট্রাকে তুলে দামেস্কের একটি সামরিক হাসপাতালে নেয়া হতো। সেখান থেকে একটি সামরিক এলাকায় গণকবর দেয়া হতো।
আন্তর্জাতিক শক্তির উদাসীনতা এবং প্রভাবশালী কিছু দেশের সমর্থনের কারণে সিরিয়ার পরিস্থিতি এখন যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তাকে মানবিক বিপর্যয় ছাড়া কিছু বলা যায় না। সেখানে ক্ষমতায় থাকার জন্য যেমনি সরকারি বাহিনী সরকারবিরোধী বেসামরিক জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করছে তেমনি সরকার বিরোধীরাও বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করছে। অনেকদিন থেকেই দেশটি এক বসবাস অনুপযোগী অনিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে। সেখানকার জনগণ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। পালাতে গিয়েও নানা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। সাধারণ মানুষদেরও কখনো কখনো ধরে নিয়ে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। বর্তমান যুগে এমন নৃশংস ও বর্বর ঘটনা বিরল। অথচ প্রত্যেকেরই আতা¥পক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া নৈতিক ও আইনগত অধিকার। বন্দি হিসেবেও সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে। মৃতের প্রতি যথাযথ সম্মানপ্রদর্শন করা হচ্ছে না দেশটিতে। এ অবস্থার অবসান জরুরি। সেখানে যা ঘটছে তাতে বিশ্ববিবেকের নিশ্চুপ থাকার সুযোগ নেই। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া আবশ্যক। সেখানকার নির্যাতিত মানুষের পাশে বিশ্ববিবেক দাঁড়াবে এটাই প্রত্যাশিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন