চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন আসার পর সকলের প্রত্যাশা ছিল দুদক এবার মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক খাতের বড় বড় কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেবে। জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, লুটপাট ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেলেও সেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা তেমন দৃশ্যগ্রাহ্য না হলেও নিম্ন স্তরের ছোটখাটো দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে দুদককে মাঠ গরম করতে দেখা যাচ্ছে। যেখানে দেশের রাজস্বে অন্যতম যোগানদাতা চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজকে এখন ঘুষের হাট বলে অভিহিত করা হচ্ছে, এবং যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ঘুষ ও অবৈধ লেনদেন হচ্ছে সেখানে দুদকের কোনো ভূমিকা নেই। দুদক সেখানকার রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজদের কাউকে ধরতে না পারলেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে গ্রেফতার করে বাহবা কুড়াচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, দেশের প্রতিটি সেক্টরের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই নানা ধরনের দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেন হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উপর নজরদারি করে ও ফাঁদ পেতে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করাও দুদকের দায়িত্ব। তবে দুর্নীতির মূল উৎসগুলো বন্ধ না করে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ব্যক্তিকে ধরলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে না।
ঘুষ গ্রহণের সময় দুদকের হাতে ধরাপড়া চসিকের কথিত কর্মকর্তা নিজেকে নির্দোষ দাবী করে ঘুষের এই ফাঁদকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবী করেছেন। তার ভাষ্য মতে, চসিক অফিসেই অনেক বড় বড় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রয়েছেন, চসিকের টিও বা ট্যাক্স কর্মকর্তা হওয়ার জন্য লাইনে থাকা ব্যক্তিরাই একজন সৎ কর্মকর্তাকে ফাঁসাতে এই ঘুষের নাটক করেছেন বলে তার দাবী। তার এই দাবী যদি সত্য হয়, তাহলে কথিত দুর্নীতি বিরোধী অভিযানও পরোক্ষভাবে আরেকটি দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়ছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আমরা স্মরণ করতে পারি, গত বছর আগস্টের প্রথমদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র চসিকের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ নিতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ৫ শতাংশ ঘুষ দাবী করেছিলেন বলে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন। সে সময় মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দুদকের পক্ষ থেকেও চসিক মেয়রের এই অভিযোগ খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছিল। এ সম্পর্কে তদন্ত করতে দুদক অনুসন্ধান কর্মকর্তাও নিয়োগ দিয়েছিল বলে জানা যায়। ইতিমধ্যে ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও দুদকের সে অনুসন্ধানের কোন রিপোর্ট এখনো প্রকাশিত না হওয়াও সন্দেহজনক। দুদক কি বড় বড় দুর্নীতিবাজদের কাছে ম্যানেজ হয়ে ছোটখাটো দুর্নীতি ও ঘুষের ঘটনা নিয়ে হইচই করে দুর্নীতির মূল উৎস ও প্রকৃত অবস্থাকে আড়াল করতে চাচ্ছে কিনা জনমনে এখন এমন সন্দেহ ও পারসেপশন তৈরী হচ্ছে। ইতিপূর্বে দুদকের অভ্যন্তরে দেড় শতাধিক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছিল। গতমাসেও দুদক চেয়ারম্যান দুদক ও এনবিআর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। চলতি বছর দুদকের দুর্নীতি বিরোধী কর্মকা- দৃশ্যমান হবে বলেও দুদক চেয়ারম্যান জানিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দুর্নীতি বিরোধী এক মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, দুদকের চলমান দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের কারণে ঘুষের রেট বেড়ে গেছে। তিনি বলেছেন, আগে যেখানে ১০ টাকা ঘুষ নেয়া হত এখন সেখানে ১০০ টাকা ঘুষ নেয়া হচ্ছে। এই যদি হয় দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের বাস্তব ফলাফল, তাহলে এসব অভিযানের কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারী-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতিমূলক নিয়োগ-বাণিজ্য, কমিশন-বাণিজ্য, রাজনৈতিক দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছতা বন্ধের কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে ঘুষগ্রহণের দায়ে নিম্নস্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফাঁদ পেতে ফটোসেশন করে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়। যেখানে সিভিল প্রশাসনের প্রতিটি সেক্টরেই নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে সততা, দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা বিবেচনা না করে মোটা লেনদেন ও রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দুদককে মামলাবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে দু’চারজন ঘুষখোরকে ধরে শাস্তি দিলেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি-লুটপাট, শেয়ারবাজার কারসাজি, ডেস্টিনি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি জনসম্মুখে প্রকাশিত হওয়ার পর বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও নেপথ্যের প্রভাবশালীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়সহ আর্থিক অনিয়ম সম্পর্কে দুদকের ভূমিকা কখনো দৃশ্যমান হয়নি। দুদক সম্পর্কে জনগণের পারসেপশন এবং আস্থার সংকট দূর করতে হলে দুর্নীতির মূলে হাত দিতে হবে। ঘুষ-দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নামে লোক দেখানো তামাশা বন্ধ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন