রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জেলে ও সমুদ্রসম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উপকূলীয় এলাকায় জেলে নৌকায় নৌদস্যুদের ডাকাতি, অপহরণ, লুণ্ঠন-চাঁদাবাজি বেড়েই চলেছে। গত এক সপ্তায় খুলনাঞ্চলে শতাধিক জেলে নৌদস্যুদের হাতে আটক হয়েছে। এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক জেলেকে মুক্তিপণ আদায়ের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সুন্দরবনের আশপাশ এবং দক্ষিণের জেলাগুলোর বিভিন্ন স্থান থেকে অপহৃত শতাধিক জেলে পরিবারের কাছে ব্যক্তি ভেদে ৩০ হাজার টাকা থেকে দুইলাখ-তিনলাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবী করেছে দস্যুরা। মহাজনী নৌকায় কাজ করা দরিদ্র দিনমজুর জেলেদের পরিবারগুলোর কেউ কেউ বসতঘর ও ভিটেমাটি বিক্রি অথবা বন্ধক রেখে টাকা যোগাড় করে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে ছাড়িয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা এসব ব্যক্তিরা উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়েছে বা দস্যু ও ডাকাত বাহিনীর কাছে কতটা অসহায় এবং জিম্মিদশায় পতিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাব-কোস্টগার্ডের গুলিতে ও বন্দুকযুদ্ধে বিভিন্ন নৌদস্যু বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যদের অনেকেই নিহত অথবা আটক হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে তাদের সংখ্যা এবং প্রতাপ-প্রতিপত্তির তুলনায় পুলিশি তৎপরতা খুবই অপ্রতুল। এসব অভিযান দস্যুদের তৎপরতা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে এবং সুন্দরবনসহ সমুদ্র মোহনার নদীগুলোতে দস্যুরাই যেন হাজার হাজার জেলের জীবন জীবিকা ও ভাগ্য নিয়ন্তায় পরিণত হয়েছে।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে বাংলাদেশের কৃষক এবং জেলেরা অভাবনীয় ভূমিকা পালন করছে। দেশের ষোলকোটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের যোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি মৎস্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রায় শত শত কোটি টাকা আয়ের পথও ক্রমে সম্প্রসারিত করে চলেছে আমাদের জেলেরা। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মূলশক্তি সমুদ্রগামী জেলেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, উদাসীনতা অথবা ব্যর্থতা মেনে নেয়া যায় না। বছরের পর বছর ধরে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের জেলেরা এমন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছে। উত্তাল সমুদ্রে মৌসুমী ঝড়- জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির চেয়েও নৌদস্যুদের উৎপাত ও নির্মমতার শিকার হয়ে জেলেদের প্রাণ দিতে হচ্ছে। ইলিশের ভরা মৌসুমেও উপকূলীয় দ্বীপ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া-সোনাদিয়া চ্যানেলে পানিদস্যুদের ভয়ে হাজার হাজার জেলের সাগরে মাছ ধরতে না গিয়ে নদী মোহনায় অলস সময় কাটানোর খবর নতুন নয়। এর ফলে হাজার হাজার জেলে পরিবারের রুটি-রুজি এবং দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হলেও সরকারের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোও যেন অসহায় হয়ে পড়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পাশাপাশি সরকার নানাবিধ উন্নয়নের রাজনৈতিক গালগল্প প্রচার করছে। অথচ দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম নিয়ামক জনশক্তি হিসেবে জেলেদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে।
একই সময়ে শতাধিক জেলে দেশের অভ্যন্তরীণ পানিসীমা থেকে অপহৃত হওয়ার ঘটনা নানামাত্রিক উদ্বেগের জন্ম দিচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে এ ধরনের ঘটনার তথ্য দেশের গ-িতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীনতা এবং আস্থার সংকটে ভুগছে। বিদেশী নাগরিক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত চরম নিরাপত্তাহীনতার শিকার। দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধের মীমাংসা হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আহরণ এবং তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নতুন গতি সঞ্চার হওয়ার যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছিল, তার কোন সুফল এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর থেকে আমাদের জেলেরা যেন আরো অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। একদিকে দেশীয় বনদস্য-নৌদস্যুদের সন্ত্রাস অন্যদিকে বাংলাদেশের নৌসীমায় ভারত, মিয়ানমারসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা জেলে ও নৌদস্যুদের লুটপাট, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে আমাদের জেলেরা। সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গোপসাগরের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্লু ইকোনমি নিয়ে বিশাল সম্ভাবনার কথা বলা হলেও এসব সম্ভাবনাকে জনকল্যাণে কাজে লাগানোর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সাগরে অর্ধলক্ষাধিক জেলে নৌকার নিরাপত্তার পাশাপাশি সামগ্রিক সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও র‌্যাবের সার্বক্ষণিক টহল জোরদার করার কথাও শোনা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বাস্তবে তার প্রতিফলন অনুপস্থিত। ৫ লক্ষাধিক জেলে, মাঝি-মাল্লার জীবন মারাত্মকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, সমুদ্রসম্পদের অধিকার এবং সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতে হলে সমুদ্রোপকূলে অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের নৌদস্যুতা মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জনবল, টহলবোট ও নৌযানবৃদ্ধির পাশাপাশি অত্যাধুনিক ভিজিলেন্স, সার্ভিলেন্সের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত সরঞ্জামসহ যা কিছু করনীয় তার সবই করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন