দেশের আবাসন খাতের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল এই খাতে বিপুল অংকের বিনিয়োগ রয়েছে। উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে এ খাতে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে। এর সঙ্গে ইট, সিমেন্ট, রড, বালু, টাইলস, কাঠ ইত্যাদি সামগ্রী ব্যবসা ও এ সবের সঙ্গে বহু সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান বা আয়-রোজগার সংযুক্ত হয়েছে। আবাসন খাতের নাজুক অবস্থার কারণে এসব ক্ষেত্রেও ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমোন্নতির দাবি যতই করা হোক, বাস্তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা আদৌ সন্তোষজনক নয়। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ অনেক দিন ধরেই প্রায় স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধি ছাড়া শিল্পায়ন, উৎপাদন, রফতানি, কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন ও প্রসার আপনা-আপনি হওয়ার কোনো হেতু নেই। যখন বিনিয়োগ নাস্তির পরিস্থিতি অনির্দিষ্টকাল ধরে বিরাজ করে তখন দেশের অবস্থা কী হতে পারে, তা বিশদ ব্যাপার অপেক্ষা রাখে না। দেশের মানুষের বাসস্থানের যথেষ্ট অভাব আছে। মানবেচ্ছার একটা বড় দিক হলো, প্রতিটি মানুষই তার নিজের একটি ঘর বা বাসস্থান একান্তভাবেই কামনা করে। এ জন্যই তার দরকার প্রয়োজনীয অর্থ। কিন্তু ব্যক্তি অর্থনীতি এতটাই অনির্দিষ্ট ও ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, কারো পক্ষে নিজস্ব গৃহের সাধ পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। জাতীয় অর্থনীতি স্ফীত ও প্রবহমান থাকলে ব্যক্তি অর্থনীতিতেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ত। মানুষের ভোগ ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ত। বস্তুত, আবাসন খাতে যে বৈরী পরিস্থিতি বিদ্যমান তার সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার অনিবার্য ও নিকট সম্পর্ক রয়েছে। আবাসন খাত যেহেতু গণস্বার্থই কেবল নয়, গণকল্যাণের সঙ্গেও যুক্ত সুতরাং এ খাতের উজ্জীবন একান্তভাবেই প্রত্যাশিত।
আবাসন খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা নানা রকম সঙ্কটের সম্মুখীন। তাদের বিনিয়োগ বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে। হাজার হাজার ফ্ল্যাট ও প্লট অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কেনাবেচা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কম। গত ১৪ মাস আগের রিহ্যাবের একটি হিসাবে দেখা যায়, স্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার ফ্ল্যাট ও ৫ হাজার প্লট হস্তান্তর হতো সেখানে ২০১২-১৪ সালে তা নেমে সাড়ে ৫ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। বলা বাহুল্য, ইতোমধ্যে এ সংখ্যা আরো কমেছে। ফ্ল্যাটের উচ্চ নিবন্ধন ফি, স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়া, উৎসে আয়কর বৃদ্ধি, ক্রেতার অর্থের উৎস সন্ধানের নামে এনবিআর ও দুদকের হয়রানি ইত্যাদি এ অবস্থার জন্য বিশেষভাবে দায়ী। আবাসন খাতে কেনাবেচা এভাবে কমে যাওয়ায় এর সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৩শ’ সহযোগী শিল্পও অস্তিতের হুমকির মধ্যে পতিত হয়েছে। উল্লেখ করা আবশ্যক, গত শতাব্দীর ৯০ দশকের শুরুতে অর্থনীতির সম্ভাবনাময় নতুন খাত হিসেবে আবাসন খাতের শুভ সূচনা হয়। এ পর্যন্ত এ খাতে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ৩৫ লাখ লোকের। এর সহযোগী শিল্পগুলোতে প্রচুর বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন মূল ও সহযোগী শিল্প খাতগুলো সবই চরমভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন চট্টগ্রামে চার দিনব্যাপী বিহ্যাব মেলার উদ্বোধনকালে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য। তিনি ফ্ল্যাট ও প্লট ক্রেতাদের টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন না করতে এনবিআর ও দুদকের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘১৪ শতাংশ কর দিয়ে হাউজিং সেক্টরের ব্যবস্থা করতে হয়। পাশাপাশি সিমেন্ট, রড, টাইলস, গ্লাসসহ ভবন নির্মাণের যাবতীয় সামগ্রীর কর-ভ্যাট দিতে হয়। এরপরও এনবিআর- দুদক এসে বলে এত টাকা কোথায় পাচ্ছেন?’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আবাসন খাতকে প্রণোদনা দিতে হবে। টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে না চাওয়াও একটি প্রণোদনা।’ প্রসঙ্গত তিনি উল্লেখ করেছেন, টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে দেশের টাকা বাইরে চলে যাবে এবং দেশের মানুষ বাইরে অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। স্মরণ করা যেতে পারে, আবাসন খাতের সুরক্ষায় অপ্রদর্শিত আয় বিনা প্রশ্নে এ খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেয়ার পরও যথোচিত সুফল পাওয়া যায়নি। না পাওয়ার বড় কারণ, এনবিআর ও দুদকের হয়রানির আশঙ্কা। অথচ বিগত বছরগুলোতে মালয়েশিয়া, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে বাংলাদেশীরা প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। ওই দেশে টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হয় না। এনবিআর-দুদক যদি দেশের আবাসন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন না করে, হয়রানির আশঙ্কা যদি না থাকে তাহলে ফ্ল্যাট ও প্লট কেনাবেচা বাড়বে, এখানেই বিনিয়োগ হবে, বাইরে টাকা পাচার হয়ে যাবে না। বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে। এই সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ফ্রি হ্রাসসহ অন্যান্য প্রণোদনাও দিতে পারে। আবাসন খাত গতিশীল করার জন্যই নয়, গণস্বার্থে এবং টাকা পাচার রোধে এসব প্রণোদনা ও পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন