মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, হত্যা ও নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে বাংলাদেশ নিযুক্ত ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার রাষ্ট্রদূত কক্সবাজারের উখিয়া যান। তারা সেখানকার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। রোহিঙ্গাদের ওপর কীভাবে জাতিগত নির্মূলন অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, কীভাবে হত্যাকা-, নির্যাতন ও ধর্ষণের তা-ব চালানো হচ্ছে, রাষ্ট্রদূতগণ রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে তা বিশদভাবে জানতে পারেন। তারা জানতে পারেন, রোহিঙ্গারা ন্যায়সঙ্গত প্রতিকার চায়, নিরাপত্তা চায়, নাগরিকত্ব ফেরৎ চায় এবং দেশে ফিরে যেতে চায়। এ সময় রাষ্ট্রদূতগণ রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেন। রাখাইনে যে জাতিগত উৎসাদন ও গণহত্যাই চলছে, অনেক আগে থেকেই সে কথা বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা বলে আসছে। এই নির্মম, হত্যাকা-, নির্যাতন বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার প্রদানের জন্য তাদের অনুরোধ মিয়ানমার সরকার পাত্তা দেয়নি। সেখানে কী ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন হচ্ছে, মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে তাও দেখতে দেয়নি। রোহিঙ্গা সম্পর্কিত কফি আনান কমিশনের সদস্যদের সরেজমিন পরিদর্শনে বাধা দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবনবাজি রেখে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। আগে থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়ে আছে। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে আরো হাজার হাজার এসেছে। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় রকমের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির গভীরতা স্বচক্ষে অবলোকন ও বোঝার জন্য শুধু আলোচ্য তিন দেশের কূটনীতিকগণই কেবল কক্সবাজার ছুটে যাননি, এর আগে ৩১ জানুয়ারি মার্কিনরাষ্ট্রদূতও উখিয়া ও টেকনাফের শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। তারও আগে ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি কফি আনান কমিশনের সদস্যরা ওই দুই শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। তারা সবাই একমত যে, রাখাইনে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, আটক ও ধর্ষণসহ সব ধরনের নির্যাতনই করা হচ্ছে।
বিশ্বের প্রভাবশালী দেশসহ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন এবং জাতিসংঘও এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। তাদের এই তৎপরতা ও অভিমত থেকে এটা স্পষ্ট যে, রোহিঙ্গা সমস্যা মোটেই আর এখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এটা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশে এই সমস্যার অন্যতম ফলভোগীতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের বিষয়টিও যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে রয়েছে, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্রদূতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন তার প্রমাণ বহন করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। শরণার্থীদের যে চাপ অব্যাহত হয়েছে, তা বহন করাও সম্ভব নয়। এ জন্য জোরালোআন্তর্জাতিক উদ্যোগ যেমন দরকার তেমনি বাংলাদেশের জন্য দরকার ব্যাপক সমর্থন ও সহযোগিতা। বিভিন্ন দেশের তরফে বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদানের যে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, তা আশাব্যঞ্জক। একথা সকলেই বিশ্বাস করে, জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী দেশগুলো উদ্যোগ নিলে রোহিঙ্গা সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান সম্ভবপর হতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। যথাযথ কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে প্রতিবেশী চীনসহ প্রভাবশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এ সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারে। এটা রোহিঙ্গাদের জন্য যেমন প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনতে পারে, একইভাবে বাংলাদেশ শরণার্থী সমস্যা থেকেও মুক্ত হতে পারে।
এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ তার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেও আরো জোরদার করে তুলতে পারে। পর্যবেক্ষক মহলে অজানা নেই, বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক একটা বৃত্তাবদ্ধ অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। যেন ভারত ছাড়া আর কোনো বন্ধু নেই, এমন একটা অবস্থা তৈরি রয়েছে। ফলে দেশ বহির্বিশ্ব থেকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যা জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় মোটেও শুভবার্তা বহন করে না। রোহিঙ্গা ইস্যুকে ভিত্তি করে ভারতের গ-ি থেকে বেরিয়ে আসার এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। কথিত দেশগুলোকে সঙ্গী করে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। আর এই চেষ্টা ও প্রয়াসের মধ্য দিয়ে ওই দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে। যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়, কাজেই প্রভাবশালী দেশসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা লাগবেই। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সার্বিক নিরাপত্তা ও বিকাশ নিশ্চিত করা। সবাইকে উদ্যোগী হয়ে সেটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সফল না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর যখনই সফলতা আসবে তখনই বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে। শরণার্থী ব্যবস্থাপনা ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি এখন সিভিল প্রশাসন করছে, করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ নিয়ে বিতর্ক যেমন হচ্ছে, তেমনি স্থানীয়দের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতেও দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায়, সরকারের উচিৎ হবে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীর কতৃত্বে অর্পণ করা। তুরস্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর নজির ও উদাহরণ রয়েছে। পরিশেষে আমরা আশা করবো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংস্থা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে দ্রুত এগিয়ে আসবে এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন