প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক রোগী বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য চলে যাচ্ছে। দেশের চিকিৎসকের অবহেলা, ঠিকমতো রোগী না দেখা, ভুল চিকিৎসা ও ডায়াগনোসিস এবং অত্যধিক চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে রোগীদের আস্থা দিন দিন কমে তলানিতে এসে ঠেকেছে। ফলে লাখ লাখ রোগী অপেক্ষাকৃত কম খরচে উন্নত চিকিৎসা পেতে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং বিশেষ করে ভারতমুখী হয়ে পড়েছে। এতে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে চলে যাচ্ছে। ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী গত বছরের প্রথম ছয় মাসেই সে বাংলাদেশী রোগীদের জন্য ৯৭ হাজার মেডিক্যাল ভিসা ইস্যু করেছে। ভারতের একটি বেসরকারি সংস্থা বলেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকেই বেশি রোগী ভারতে আসে। এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশে ভাল স্বাস্থ্য সেবার অবকাঠামো এবং দক্ষ স্বাস্থ্য জনশক্তির অভাবকে দায়ী করা হয়। বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, বিগত বছরগুলোতে দেশে ভাল চিকিৎসা সেবা গড়ে না উঠায় রোগীরা পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিপুল সংখ্যক রোগীর দেশের বাইরে চলে যাওয়াকে তারা উন্নত চিকিৎসা সেবা আমদানি হিসেবে দেখছেন। যদিও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব অস্বীকার করে বলেছেন, বাংলাদেশের রোগীরা শুধুমাত্র দেশে উন্নত চিকিৎসার অভাবে বিদেশ যাচ্ছে না। এটা রোগীদের ব্যক্তিগত এবং যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, চিকিৎসা নিতে রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়ার মূল কারণই হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেও যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়া।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে কতটা সেবা ও সুচিকিৎসা পাওয়া যায়, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। অনেক চিকিৎসকের রোগীদের প্রতি নিদারুণ অবহেলা, সামর্থ্যরে বাইরে চিকিৎসা ব্যয় এবং অর্থ খরচ করেও চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে রোগীরা অসহায় হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে এ প্রবণতা নতুন নয়। এ নিয়ে রোগীদের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তার উপর ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভুল চিকিৎসায় একজন রোগী মারা গেলে তার প্রতিক্রিয়া সব রোগীর উপরই পড়ে। মানসিকভাবে তাদের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হয়। এমনও দেখা গেছে, বেসরকারি খাতে যেসব বড় বড় স্পেশালাইজড হাসপাতাল গড়ে উঠেছে, সেখানে চিকিৎসার নামে এক ধরনের ব্যবসা চলে। ব্যবসাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। কোনো কোনো হাসপাতাল রয়েছে যেখানে আইসিইউতে রোগী ঢুকিয়েই বিরাট অংকের বিল হাতে ধরিয়ে দেয়। এমনকি রোগীর মৃত্যু হলেও তাকে আরও দুই-তিন দিন রেখে হাসপাতালের বিল উঠিয়ে মৃত ঘোষণা দেয়া হয়। এসব ঘটনা এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেট। এতে বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন উঠে যাচ্ছে। এর বিপরীতে রোগীরা তুলনামূলক কম বা সমান খরচে দেশের বাইরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই দেশের চিকিৎসা ব্যবসা পাশ কাটিয়ে উন্নত সেবা পাওয়ার জন্য তারা পার্শ্ববর্তী ও অন্যান্য দেশকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এটাও নতুন করে বলার কিছু নেই, দেশের অনেক চিকিৎসকের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। তারা চিকিৎসাকে সেবা হিসেবে গণ্য না করে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্য এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের চেম্বার থেকে আরও অনেক চেম্বারে ছুটাছুটি করতে গিয়ে নিজেরাই হাঁপিয়ে উঠেন। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে কি সঠিকভাবে রোগী দেখা সম্ভব? এতে তাদের সাথে কেবল রোগীর সাক্ষাৎই হয়, যথাযথ চিকিৎসা আর হয় না। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও সিংহভাগ রোগীর চিকিৎসা এখানেই হয়। তারা ভালও হয়। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, বৃক্ষ মানবের যে সফল চিকিৎসা হয়েছে, তার চিকিৎসার ভার কোনো বেসরকারি হাসপাতাল নেয়নি, সরকারি হাসপাতালই নিয়েছে এবং সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে রোগীদের প্রলুব্ধ করে অত্যধিক ব্যয়ে চিকিৎসা করিয়ে রোগীর অবস্থা আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। ফলে রোগীদের কষ্ট হলেও বাধ্য হয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ও অন্যান্য দেশমুখী হতে হয়। এতে শুধু মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রাই আমরা হারাচ্ছি না, বিদেশে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও করুণ চিত্র ফুটে উঠছে। আমরা অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো বলে যে আশাবাদ ব্যক্ত করছি, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি এত দুর্বল থেকে যায়, তাহলে কীভাবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাবো। কোটি কোটি রুগ্ন মানুষ নিয়েই কি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো? বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, দেশের যারা নীতিনির্ধারক ও রাজনীতির কর্ণধার, তাদের নিজেদেরও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থা নেই। সামান্য অসুস্থ বোধ করলে বা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য তারা বিদেশ চলে যান। তাদের চিকিৎসার এই বিদেশমুখী প্রবণতার প্রভাব স্বাভাবিকভাবে জনগণের উপর পড়ে। কারণ, জনগণ ভাল করেই জানে দেশে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে, নেতারা বিদেশ যেতেন না।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করতে হলে রাজনৈতিক কমিটমেন্টের বিকল্প নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ যদি স্বল্প ব্যয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে পারে, তবে আমরা কেন পারব না? আমরা বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি, অথচ স্বাস্থ্য খাতটিকে উন্নত করতে পারছি না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতির সাথে স্বাস্থ্যখাত যে তাল মেলাতে পারছে না, তা বিপুল সংখ্যক রোগীর দেশের বাইরে চলে যাওয়া থেকেই বোঝা যায়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ থেকে রোগী ভাগিয়ে নিতে কলকাতাসহ অন্যান্য শহরে বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছে। বাংলাদেশের রোগীদের টার্গেট করে উন্নত মানের হাসপাতাল গড়ে তুলছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সরকারি ও বেসরকারি খাত দেশে রোগী ধরে রাখার মতো কার্যকর কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারছে না। বরং রোগীর সাথে চিকিৎসকের নেতিবাচক আচরণ, সেবার পরিবর্তে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসা দিয়ে রোগীর আস্থা নষ্ট করে ফেলছে। বেশিরভাগ চিকিৎসক রোগীর আস্থা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা পেশাটাকে সেবার পরিবর্তে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। এ প্রবণতাই রোগীদের বিদেশমুখী করে তুলেছে। আমরা মনে করি, সরকারকে অন্যান্য খাতের মতো দেশের স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গণ্য করতে হবে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় আধুনিক মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্টসহ দক্ষ টেকনিশিয়ান গড়ে তুলতে হবে। চিকিৎসকদের ব্যবসার পরিবর্তে সেবামনস্ক হতে হবে এবং রোগীর সেবা মুখ্য হয়ে উঠতে হবে। আশপাশের দেশের চিকিৎসকরা যদি কম বা সমান খরচে উন্নত চিকিৎসা দিয়ে আমাদের রোগীর আস্থা অর্জন করতে পারে, তাহলে আমাদের চিকিৎসকরা কেন পারবে না?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন