কক্সবাজার শহরকে বলা হয় পর্যটন নগরী। এই অভিধাটি যতটা আমাদের আকাক্সক্ষার মধ্যে আছে, ততটা বাস্তবে নেই। না থাকার কারণ, পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজার শহরকে যেভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল অতীতে সেভাবে গড়ে তোলার কোনো ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের জন্য কক্সবাজার প্রকৃতির এক অনন্য-সাধারণ উপহার। সমুদ্রের উপকূলে পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা কক্সবাজারের নয়নাভিরাম দৃশ্যের কোনো তুলনাই হয় না। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের অবস্থান এখানেই। সমুদ্র সৈকতের কোল ঘেঁষে কক্সবাজার শহরকে পর্যটন নগরী হিসেবে এবং গোটা কক্সবাজার এলাকাকে সম্ভাবনার আলোকে গড়ে তোলা সম্ভব হলে তা হয়ে উঠতে পারে জাতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ লাইফ লাইন। পর্যটন সম্ভাবনা ছাড়াও শিল্প-অর্থনীতির ব্যাপক সম্ভাবনা কক্সবাজারে রয়েছে। এদিকে এতদিন সেভাবে নজর দেয়া না হলেও বর্তমান সরকারের আমলে কক্সবাজারের সার্বিক উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে, যার বাস্তবায়ন এখন জোর কদমে চলছে। পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজার শহরকে সাজানোর সর্বমুখী প্রস্তুতি চলছে। একই সঙ্গে অন্যান্য এলাকার উন্নয়নেও নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। সমুদ্র সৈকতকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প থেকে অনেক দেশের অর্থনীতিতে বড় অংকের অর্থের যোগান আসে। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প থেকেও দেশের অর্থনীতিতে কিছু অর্থ আসে বটে, তবে তা সম্ভাবনার তুলনায় খুব বেশি নয়। কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প থেকে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে সৈকতের উন্নয়নসহ অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিশ্বে এমন অন্তত ১১টি দেশ রয়েছে বলে জানা যায় যাদের সমুদ্র সৈকত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সেই সব দেশের সমুদ্র সৈকত পর্যটন-বান্ধব করে গড়ে তোলা হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকেও এখন সেভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেছেন, এ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বিশ্বের শীর্ষ ১০টি সমুদ্র সৈকতের মধ্যে চলে আসবে।
সমুদ্র সৈকতের উন্নয়ন ও পর্যটন-বান্ধব সুবিধাদি নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত প্রকল্পগুলো ছাড়াও ঘটিভাঙ্গা, সোনাদিয়া, কুতুবজোম ধলকাটায় জেগে ওঠা প্রায় ১৬ হাজার একর এলাকার উন্নয়নে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার ৩০টিরও বেশি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেছে। এসব প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হলে জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন প্রাণাবেগ সঞ্চারিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এমনটাও মনে করা হচ্ছে, কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত থেকে বছরে যে অর্থ আসবে, তা গার্মেন্ট বা জনশক্তি রফতানি থেকে আসা অর্থের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে যাবে। এখন সমুদ্র সৈকতকে ঘিরে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তাতে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ছাড়াও বিনিয়োগ রয়েছে চীন, জাপানসহ বিভিন্ন উন্নত দেশের। প্রকল্পগুলো শেষ হলে যোগাযোগ ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন এলাকায় পরিণত হবে। গৃহীত প্রকল্প বা যাদের কাজ শুরু হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পিডিবির তত্ত্বাবধানে হোয়ানোক-কালমারছড়ায় ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহেশখালীতে ৭টি ও টেকনাফে ৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া দোহাজারী কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণ হচ্ছে, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে, রামুতে হচ্ছে বিকেএসপি, পেকুয়ায় সাবমেরিন ঘাঁটি, ঠাকুরতলায় কোস্টগার্ডের স্টেশন। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজ, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজ এবং রামুতে সেনাবাহিনীর দশম পদাতিক ডিভিশনের সেনানিবাস।
কক্সবাজার শহরসহ গোটা কক্সবাজারে নির্মাণ, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের যে বিশাল কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কেবল কক্সবাজারের মানুষই নয়, সমগ্র দেশের মানুষই এতে উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত। কক্সবাজারের বিপুল সম্ভাবনাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার বিনিয়োগ এবং সহযোগিতাকে আমরা অকুণ্ঠ সাধুবাদ জানাই। আমরা মনে করি, গৃহীত ও বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর সবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজার শহরের প্রতিষ্ঠাসহ সমগ্র কক্সবাজারের চেহারা পাল্টে যাবে। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই একটা নয়া দিগন্তের উন্মোচন ঘটবে। দেশ ও দেশের মানুষ এর সুফল ভোগ করবে। আমরা উন্নয়নের এই রোড ম্যাপের সফল বাস্তবায়ন কামনা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন