সীমান্তে হত্যাকান্ডে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পালন করছে না ভারত। উপরন্তু সীমান্তে হত্যাকান্ডের সংখ্যা ও মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে। এহেন বাস্তবতায় সীমান্ত হত্যা বন্ধে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বা তৃতীয় কোন পক্ষের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ককে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও অনন্য উচ্চতায় সমাসীন বলে দাবি করা হয়। দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই অনন্য সম্পর্ক কি শুধুমাত্র লিপসার্ভিস এবং একতরফাভাবে ভারতের জন্য বাংলাদেশের ভূ-খন্ড, বন্দরসহ সবকিছু বিনা মাশুলে ছেড়ে দেয়া? দুই দেশের মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক উন্নয়ন তথা মানবিক মেলবন্ধনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের চিন্তা না করেই সম্পর্কের এই মান কিভাবে নির্নীত হয় তা আমাদের বোধগম্য নয়। একদিকে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্কের দাবি করা হচ্ছে, অন্যদিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষি বাহিনী বিএসএফ যত্রতত্র পাখির মত গুলি করে সীমান্তে বসবাসরত নিরস্ত্র দরিদ্র গ্রামবাসিদের হত্যা করে চলেছে। একদিকে দীর্ঘ স্থলসীমান্তে ভারত দুর্ভেদ্য কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে অন্যদিকে বন্ধুত্বের বুলি আওড়াচ্ছে এবং বিভিন্ন সময়ে সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধের আশ্বাসও দিচ্ছে। কিন্তু কখনো এ আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিশ্বের শত শত রাষ্ট্র আন্ত:রাষ্ট্রীয় স্থল ও নৌসামান্ত শেয়ার করছে। পাশাপাশি অবৈধ ইমিগ্রেশন, চোরাচালান এবং সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সমস্যাও একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত। মানচিত্রের রাজনৈতিক সীমারেখা জাতিসমূহের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে ঘুচিয়ে দিতে পারে না। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং পারষ্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কোনটিই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ভারত একদিকে তার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশের সহযোগিতা নিচ্ছে, বাংলাদেশের উপর দিয়ে স্থল ও নৌ-ট্রানজিটের নামে বাণিজ্যিক করিডোরের সুযোগ নিচ্ছে, অন্যদিকে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, কাঁটাতারের পাশে পাহারারত বিএসএফ সদস্যদেরকে ‘শুট টু কিল’ পলিসির প্রেসক্রিপশন দিয়ে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা করছে। সীমান্ত এলাকার কৃষক, রাখাল, গরু ব্যবসায়ী এবং ফেলানীর মত কিশোরিরা তাদের মারণাস্ত্রের টার্গেট হলেও সীমান্তের ওপার-এপারের ফেন্সিডিল পাচারকারিরা সব সময়ই টার্গেটের বাইরে। বাংলাদেশ থেকে শত শত টন ইলিশ মাছ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে ফেন্সিডিলসহ নানা ধরনের মাদক। গরুর রাখাল ও গরু ব্যবসায়ীরা বিএসএফ’র গুলিতে প্রাণ হারালেও কখনো অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের গুলিতে মরে না। ভারত থেকে আসা এসব অস্ত্র ও মাদক বাংলাদেশের যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরী করেছে।
গত সোমবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে ২২ বছর বয়েসী এক বাংলাদেশি যুবক নিহত এবং আরো অন্তত ৪ জন আহত হয়েছে। সীমান্তে হত্যাকান্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির মধ্যেই বিভিন্ন সীমান্তে গত এক বছরে বিএসএফ’র গুলিতে শতাধিক মানুষ হতাহত ও অপহৃত হয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ’র বেড়া নির্মাণ, গুলিবর্ষণ এবং নানাবিধ অপতৎপরতার বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিকভাবেও বিশেষভাবে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ’র গুলী ও মানুষ হত্যা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে কয়েক বছর আগে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট করেছিলেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কর্মী ব্রাড অ্যাডামস। রিপোর্টে তিনি ২০১১ সালের আগের এক দশকে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে ১ হাজার নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যার বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন, বিনা কারণে বিনা উসকানিতে এসব হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী কাউকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি। গত বছর ঢাকার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, আওয়ামী লীগের গত ৭ বছরের শাসনামলে সীমান্তে অন্তত ১২শ’ বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফ ও ভারতীয়দের হাতে নিহত হয়েছে। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষিদের হাতেও বাংলাদেশি জেলে এবং সীমান্তরক্ষিরা আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের বিজিবি সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা বিধান এবং আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি কোন কোন সময় বিএসএফ’র ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদ জানাতে এবং প্রতিকারের উদ্যোগ গ্রহণেও আমাদের সীমান্তরক্ষি এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিস্ময়কর নিরবতা অথবা উদ্ভট ভূমিকা নিতে দেখা যায়। কখনো কখনো মনে হয়, তারা যেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষি বা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়েও ভারতের পক্ষেই ওকালতি করছেন। তবে আমরা যতই একতরফভাবে বন্ধুত্ব রক্ষার চেষ্টা করি, ভারতীয় সীমান্তরক্ষিরা যেন ততই আমাদের উপর নির্মম-বর্বর আচরণ করে চলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। সীমান্তহত্যা বন্ধে ভারতীয়রা তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব ধরনের সম্ভাব্য বিকল্প উদ্যোগ নিতেই হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন