বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় গত ৪ বছর ধরে শীর্ষ অবস্থানে পর এবার বিশ্বের দূষিত বাতাসের শহরগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে ঢাকা। এ তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি আর ঢাকার পরে অবস্থান করছে পাকিস্তানের করাচি। বেইজিং, মুম্বাই, কলকাতা, সাংহাই, কাঠমান্ডু ইত্যাদি এশিয়ার শহরগুলো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেল্থ ইফেক্ট ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ মেট্টিক্স এন্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৭’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনটি সারাবিশ্ব থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে গত আড়াই দশকে বিশ্বে বায়ুদূষণের মাত্রা সবচে বেশী বেড়েছে ভারতে এবং বাংলাদেশে। ব্যাপক শিল্পায়নের কারণে বায়ুদূষণে ইতিপূর্বে চীনের অবস্থান শীর্ষে থাকলেও গত কয়েক বছরে চীনের চেয়ে বেশী বায়ু দূষণের মাত্রা ভারত এবং বাংলাদেশে বেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষত, বায়ুতে মানবদেহের জন্য সবচে ক্ষতিকর দূষণকারী পিএম২.৫ নামক উপাদান দিল্লি ও ঢাকার বাতাসে অনেক বেশী মাত্রায় দেখা দিয়েছে। শুধুমাত্র বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বায়ু দূষণের জন্য দায়ী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চীন, ভারত, ইউরোপীয়, ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বায়ু ও ধূলোদূষণের মাত্রা ঢাকা এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে যথেষ্ট শিল্পায়ন না হলেও পরিবেশগত অসচেতনতা এবং অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বায়ুদূষণকারী রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুসারে সর্বোচ্চ বায়ু দূষণের শিকার বিশ্বের ২৫টি শহরের তালিকায় বাংলাদেশের ৩টি শহরের নাম রয়েছে। রাজধানী ঢাকা এবং তার উত্তর ও দক্ষিণের দুই শহর গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ শহর বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১০ সালের হিসাবে বায়ুদূষণজনিত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে বছরে ৯২ হাজার মানুষ মারা যায় বলে উল্লেখ করা হলেও উল্লেখিত সর্বসাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুসারে তা’ ১ লাখ সাড়ে ২২ হাজারে উন্নীত হয়েছে। আগের রিপোর্টে শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই বায়ুদূষণের শিকার হয়ে বছরে ১৩ হাজারের বেশী মানুষ মারা যায় বলে উল্লেখ করা হলেও এ সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ঢাকার বাতাসে সালফার, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সূক্ষ্ম বস্তুকণা এবং মার্কারির মত উপাদান সহনীয় মাত্রার চেয়ে বহুগুণে বেশী। বাতাসের দূষণ সৃষ্টিকারী এসব পদার্থ শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করে সব বয়েসের লাখ লাখ মানুষ নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। শুধু বাতাসের দূষণই নয়, ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলো অনেক আগেই মারাত্মক রাসায়নিক দূষণের শিকার হয়েছে। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত হওয়ার পেছনে এসব দূষণ এবং নাগরিক নিরাপত্তাহীনতার বিষয়গুলোই মূলত দায়ী।
চীন ও ভারত বিশ্বের অন্যতম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি। তাদের অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান বাড়িয়ে নিজেদের বাণিজ্যিক অবস্থান ধরে রাখতে তারা শিল্পদূষণের ঝুঁকি গ্রহণ করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজধানীসহ শহরগুলো মারাত্মক বায়ু ও পানিদূষণের শিকার হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন। একদিকে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশগত বিবেচনা মানা হচ্ছে না, অন্যদিকে শিল্পবর্জ্য ও নাগরিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোন রকম নজরদারি এবং আইনগত মানদ- না থাকায় এসব স্বাস্থ্যগত ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ঢাকা শহরকে এখন বিষাক্ত বাতাসের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম ধূলোময় শহরে পরিণত করেছে। আবহাওয়ার বৈশ্বিক পরিবর্তনের নিয়ামকগুলো আমরা হয়তো এককভাবে পরিবর্তন করতে পারব না, তবে নগর উন্নয়ন, শিল্পায়ন, বর্জ্যব্যবস্থাপনা ও টেকসই উন্নয়নের শর্তসমূহ নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই মেনে চলা আবশ্যক। লাখ লাখ মানুষকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে, দেশের রাজধানীসহ প্রতিটি শহরকে বসবাসের অযোগ্য জনপদে পরিণত করে, এমন কোন উন্নয়ন দেশবাসীর কাছে কাক্সিক্ষত নয়। যেনতেন প্রকারে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমে আমরা আমাদের সবুজ দেশটার আকাশ, বাতাস, পানি ও মাটিকে বিষাক্ত করে তুলছি। অনতিবিলম্বে বায়ুদূষণ, রাসায়নিক বর্জ্যদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, শব্দদূষণসহ সব ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তথাকথিত উন্নয়নের চেয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাস, সুপেয় পানি ও ফুল-ফসলের উপযোগী মাটির অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা আমাদের জন্য অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন