মধ্যপ্রাচ্যের সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা মার্কিন আদালতে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর এবার মধ্যপ্রাচ্য শান্তি ও আরব ইসরাইল সংকটের মূল ইস্যু থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শতকরা ১০ ভাগের কম ইহুদি জনসংখ্যা সত্তে¡ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনের আরব ভূমিতে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া হয় ১৯৪৮ সালে। অবশ্য এর তিন দশক আগে ১৯১৭ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বালফোর ডিক্লারেশনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালফোর সেখানকার ইহুদিদের ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিনকে দুইভাগ করে বেশিরভাগ এলাকা (৫৬ শতাংশ) নিয়ে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস করে জাতিসংঘ। সঙ্গত কারণেই এই অসম, অসঙ্গত ও অন্যায্য প্রস্তাবকে মেনে নিতে পারেনি আরবরা। অন্যায়ভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগ আরবদের সমর্থন পাবে না এবং তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হবে এমন আশঙ্কাকে সামনে রেখেই পশ্চিমা অস্ত্রশক্তির বলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় ব্রিটিশ ও মার্কিনীরা। ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর উচ্ছেদ করে, হত্যা করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরোধিতা ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সুযোগে ইসরাইলীরা জাতিসংঘ প্রস্তাবের চেয়ে অনেক বেশী আরব ভূমি দখল করে নেয়। এভাবেই ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরাইল সংকটের জন্ম হয়। এর দুই দশক পরে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের কাছ থেকে আরো ভূ-ভাগ দখল করে নেয় ইসরাইল।
আরবদের তীব্র বিরোধিতা সত্তে¡ও ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আরব-ইসরাইল শান্তির লক্ষ্যে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। প্রথম দিকে এই সমাধানের পক্ষে থাকলেও সাম্প্রতিক দশকে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা ও আরবদের অনৈক্যের সুযোগে ইসরাইল এখন টু স্টেট সলিউশন থেকে সরে যেতে চাইছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনও বাহ্যিকভাবে দুই রাষ্ট্রের সমাধানের পক্ষে থাকলেও ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান এবং আরব ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার সদিচ্ছা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা একটি অনিবার্য সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলিত হয়েছে। পশ্চিমাবিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশসহ বিশ্বের দেড়শতাধিক রাষ্ট্র এবং আশি শতাংশের বেশী মানুষ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার মূল কুশীলব ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও তারা এতদিন ধরে আরব-ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলে আসছে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রæতি থেকে সরে যাওয়ার কথিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুধু বিশ্বের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ততাই বিনষ্ট করছেন না, সেই সাথে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের পথকেও রুদ্ধ করে দিতে চাইছেন।
মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মোকাদ্দাসের উপর মসুলমানদের অধিকার ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত। সম্প্রতি ইউনেস্কোর একটি ঐতিহাসিক রায়েও এই বিশ্বজনীন স্বীকৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সম্প্রতি ইউনেস্কোর এক ঘোষণায় পুরনো জেরুজালেমের উপর ইহুদিদের কোন অধিকার নাকচ করে দিয়ে পূর্বজেরুজালেমকে ইহুদিকরণে ইসরাইলী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট মত দিয়েছে। মূলত: শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলমানের ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে বহিরাগত ইহুদিদের এনে অস্ত্রের বলে ইসরাইল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভিত্তিই সমর্থনযোগ্য নয়। তথাপি বিশ্বসম্প্রদায় ১৯৬৭ সালের যুদ্ধপূর্ববর্তী সীমারেখার ভিত্তিকে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে মত দিচ্ছে। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও মধ্যস্থতা একটি আশাব্যঞ্জক লক্ষণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সর্বশেষ ওবামা প্রশাসনের শেষ সময়ে পশ্চিমতীরে ইসরাইলী বসতি স্থাপন বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়েছে। গত ৬ দশকে ইসরাইলের আগ্রাসন বিরোধী এমন অসংখ্য প্রস্তাব ইঙ্গ-মার্কিন ভোটোর কারণে বাতিল হয়ে গেছে। এবারই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে ভেটো না দেয়ায় সত্য, ন্যায় ও মানবতার সপক্ষে একটি প্রস্তাব পাস হল। অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতিসংঘের এই প্রস্তাব উল্টে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে হোয়াইট হাউজে বৈঠকের পর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তনের আভাস থেকে ট্রাম্প তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বসম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের নীতি ও প্রতিশ্রুæ্তিু থেকে সরে গিয়ে ট্রাম্পের এ বিপরীতমুখী অবস্থান মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বশান্তির জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করবে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের তরফ থেকে ট্রাম্পের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের মধ্যপন্থী নেতৃত্ব এবং আরবদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় ট্রাম্পের বিকল্প প্রস্তাব এখনো পরিষ্কার না হলেও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাওয়া কোন পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই জায়নবাদী ইসরাইলীদের পক্ষাবলম্বন করে আসছে, এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের মানবাধিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক প্রয়াস শুধু বাধাগ্রস্তই হয়নি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন