বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের এতটাই স্খলন ঘটেছে যে, অতীতে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতা-উত্তর বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখা ছাত্রলীগের সাথে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি-সংগঠনটির মূল নীতি হলেও, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, গোলাগুলি, হত্যা, কোন্দল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি যেন তার নীতি হয়ে উঠেছে। নিয়ন্ত্রণহীন এবং বেসামাল হয়ে পড়েছে সংগঠনটি। গত কয়েক বছরে সংগঠনটির যে অপকর্ম, তা দেখে স্তম্ভিত না হয়ে পারা যায় না। প্রশ্ন জাগে, এই কী সেই ছাত্রলীগ? যে আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে সংগঠনটির যাত্রা, তার প্রতিফলন কোথায়? ছাত্রলীগের কাজ কি শিক্ষাঙ্গনে মারামারি, খুনোখুনি, অস্ত্র হাতে মহড়া দেয়া? সংগঠনটির বিগত কয়েক বছরের অপকর্ম এতটাই লাগামহীন হয়ে পড়েছে যে, এসব প্রশ্ন এখন জনমনে বিরাজ করছে। সংগঠনটি যেন আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। অথচ তার নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার অপকর্ম অব্যাহত রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই প্রায় পাঁচ শতাধিক সংঘর্ষে জড়িয়েছে সংগঠনটি। এর সিংহভাগই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আট বছরে সংগঠনটির এই আন্তর্কোন্দলে ৫৭ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েকশ’। গত এক বছরেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেড় শতাধিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে। বন্ধ হয়েছে অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ক্ষমতাসীন দলের এই ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাÐের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলুষিত এবং মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলবে, এটা কি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে?
ছাত্রলীগের বিভিন্ন অপকর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতটাই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েছিলেন যে, তিনি সংগঠনটির অভিভাবকত্ব ত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তীতে ছাত্রলীগ অনেক অনুনয়-বিনয় করে তাঁকে ফিরিয়েছিল। দেখা গেল, নেত্রী ফিরলেও ছাত্রলীগ তাদের অপকর্ম থেকে বিরত থাকেনি। তার শাখা-প্রশাখার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। বরং পূর্বের চেয়ে অধিকমাত্রায় সংগঠনটির একশ্রেণীর নেতা-কর্মী সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। এমনও দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিনতাইকারী চক্রের নেতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। ছাত্রলীগের কতিপয় শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ নেতা-কর্মীদের এমন আত্মবিধ্বংসী কর্মকান্ড ছাত্রলীগ তো বটেই গোটা ছাত্র সমাজের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে ছাত্র সংগঠনগুলো সুস্থ রাজনীতির ভ্যানগার্ড এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ে আদর্শিক ভূমিকা রেখেছে। এক ছাত্রলীগের অপকর্মে তা ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। ছাত্র রাজনীতির প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। ছাত্র রাজনীতি বলতেই একটা নেতিবাচক চিত্র মানুষের সামনে ভেসে উঠে। ছাত্র রাজনীতির জন্য তা অত্যন্ত পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়। মানুষের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল, ছাত্র সংগঠন বলতে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের হলে, অবধারিতভাবেই তা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অন্যতম হাতিয়ার। তার দোর্দÐ প্রতাপে শিক্ষাঙ্গনে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ে। যুগে যুগে কমবেশি আমরা তা দেখে আসছি। এখন পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রলীগের দাপট এবং ধাওয়ায় ক্যাম্পাস ছাড়া হয়ে গেছে। বিরোধী ছাত্র সংগঠন না থাকা এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের বিষয়টি তিরোহিত হওয়ায় এখন ছাত্রলীগই সর্বেসর্বা। ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের সেখানে ঠাঁই নেই। ছাত্র রাজনীতির এই শূন্যতায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এখন নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ফাঁকা মাঠে নিজেরাই টেন্ডার দখল, চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা, হল দখল, এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। ফলে মর্মান্তিক হত্যাকান্ডসহ আহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ছাত্র রাজনীতির নামে এসব অপকর্ম করে একশ্রেণীর নেতা-কর্মী অর্থ-বিত্তের মালিক হয়ে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিণত হয়েছে। তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই, তারা ছাত্র নাকি সম্পদশালী কোনো ব্যক্তি। পড়ালেখা করা বা সংগঠনের আদর্শ ও নীতির ধারে কাছে না গিয়ে অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়াই যেন তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশে পরিণত হয়েছে।
ছাত্রলীগের অপ্রতিরোধ্য নেতিবাচক কার্যকলাপের কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রায়ই ধমক দেয়া হয়। কারো কারো বিরুদ্ধে সাময়িক বহিষ্কারমূলক শাস্তি আরোপ করতেও দেখা যায়। কয়েক দিন পর অপরাধী আবার যথাস্থানে ফিরে আসে। অর্থাৎ অপরাধের সাথে যুক্তরাও জানে সাময়িক বহিষ্কার হলেও তারা স্বল্পতম সময়ে আবার সংগঠনে ফিরে আসবে। এর ফলে তারা আরও দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীবিরোধী রাজনীতি দমনে অত্যন্ত সক্রিয় এবং মাঠ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে, সেই বাহিনী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সময় ‘সাক্ষী গোপাল’ হয়ে থাকে। প্রকাশ্যে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হলেও সেখানে তাদের কোনো বিচলন দেখা যায় না। সংঘর্ষ চলাকালে নিরাপদ দূরত্বে থেকে তা অবলোকন করে। ক্ষমতাসীন দল থেকেও ছাত্রলীগের যারা অপকর্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায় না। এর ফলে মানুষের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে, ছাত্রলীগ যেন আইনের ঊর্ধ্বে। আইন তাদের স্পর্শ করতে পারে না। আমরা মনে করি, ক্ষমতাসীন দলের উচিত, ছাত্রলীগের চলমান অপকর্মের রাশ টেনে ধরা। মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির সাথে যারাই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনগত কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীকে অপরাধী হিসাবেই বিবেচনা করতে হবে। ছাত্রলীগকে যে কোনো মূল্যে সামলাতে হবে। এভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছেড়ে দেয়া বা অপরাধ উপেক্ষা করে যাওয়া কোনোভাবেই সমীচিন হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন