দেশের আমদানি-রফতানির পণ্য খালাস-বোঝাই, স্থানান্তর, পরিবহন ইত্যাদি কাজে চট্টগ্রাম বন্দর যখন হিমশিম খাচ্ছে, চাহিদার বিপরীতে এর সক্ষমতা যখন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, তখন ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার তোড়জোড় চলছে। ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞ মহলের আশঙ্কার বন্দরের সব ধরনের সক্ষমতা না বাড়িয়ে ভারতকে ট্রানজিট দিলে দেশের আমদানি-রফতানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। সরকার এই আশঙ্কার দিকটি আমলে না নিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ যাবৎ চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো সম্প্রসারণ যতটা হয়েছে তা দেশের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। এ কারণে প্রায়ই কন্টেইনারসহ কার্গোজট, মাঝে মধ্যে জাহাজজটের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। দেশের প্রয়োজনে পণ্য হ্যান্ডলিং বেড়ে এখন বন্দরের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১৪-১৫.৫ শতাংশ। অথচ সে অনুপাতে জেটি, বার্থ, টার্মিনাল, ইয়ার্ড এবং যন্ত্রপাতির সুবিধা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। শুধু তাই নয়, জাহাজ চলাচল চ্যানেল দীর্ঘদিন সংস্কার বা ড্রেজিং না হওয়ায় নাব্য হারিয়ে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, বড় বড় জাহাজ বহির্নোঙ্গরে রেখে লাইটারিং জাহাজের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতে হচ্ছে। এতে সময়ের অপচয় ও ব্যয় দুইই বাড়ছে। এই বাস্তবতা অজানা না থাকলেও সরকার এতে পাত্তা দিচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ চেয়ে আসছে ভারত দীর্ঘ দিন ধরে। এখন সে চাইছে যত দ্রæত সম্ভব সেই সুযোগ লাভ করা। ভারতের ইচ্ছা পূরণের জন্য সরকারও যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ফেনী নদীর ওপর সেতু তৈরি হচ্ছে, দক্ষিণ ত্রিপুরায় সাবরুমের আনন্দপাড়া থেকে রামগড়ের মহামুনি পয়েন্ট পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। এই সেতু ও রেললাইন নির্মাণের লক্ষ্য হলো, সড়ক ও রেলপথে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যসামগ্রী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহে নিয়ে যাওয়া।
গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে প্রকাশিত এক খবরে জানা গিয়েছিল, ভারত কোনো রকম শুল্ক ছাড়াই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে চায়। ভারতের প্রস্তাবটা এরকম : পণ্য আনা-নেয়ার জন্য কোনো শুল্ক দেয়া হবে না। শুধু প্রশাসনিক ফি দেয়া হবে। বাংলাদেশী পণ্য আমদানি-রফতানির কাজে নিয়োজিত ব্যবসায়ীরা যে সুযোগ-সুবিধা পায় তাকেও তা দিতে হবে। দুই বন্দরে পণ্য রাখার জন্য আলাদা জায়গা দিতে হবে। খবরে উল্লেখ করা হয়েছিল, বাংলাদেশ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো ভারতের স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরের খসড়ায় এসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ভারত চাইছে বাংলাদেশ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় দ্রæত তার সিদ্ধান্ত জানাবে, যাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বন্দর ব্যবহার সংক্রান্ত ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। বলা বাহুল্য, ভারতের এ প্রস্তাবকে মামাবাড়ির আবদার বলেই অভিহিত করা যায়। ভারতের প্রস্তাবের ব্যাপারে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, আমাদের জানা নেই। আমাদের বিস্ময় জাগ্রত হয় এই ভেবে যে, ভারত ওই ধরনের প্রস্তাব দিতে পারে কিভাবে। বিশ্লেষকদের ধারণা, সরকারের নতজানু নীতির কারণেই ভারতের পক্ষে এমন বেপরোয়া ও একদেশদর্শী প্রস্তাব দেয়া সম্ভবপর হয়েছে।
এ কথা দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের যা কিছু চাওয়া তার, প্রায় সবই সে ইতোমধ্যে নিয়ে নিয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি। দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারত চার দশকের বেশি সময় আগে নিয়েছে, আর সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময় করেছে এই সেদিন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সশস্ত্র বিরোধীদের দমনে বাংলাদেশের কাছে চাওয়া সহযোগিতা সে প্রায় অবলীলায় পেয়েছে। ট্রানজিট-কোরিডোর সুবিধাও সে ভোগ করছে। অথচ আজ পর্যন্ত গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ পায়নি। তিস্তা চুক্তি হয়নি। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হয়নি। এখন সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের চুক্তি হলে ভারতের চাওয়ার বোধকরি আর তেমন কিছুই থাকবে না। ভারত সরকার যেমন তার দেশের স্বার্থের বাইরে কোনো কিছু করতে নারাজ, বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত তার দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া। যেহেতু ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার কোনো বাস্তবতা ও সুযোগ নেই, সুতরাং সরকারকে এ সম্পর্কিত ট্রানজিট চুক্তি করা মোটেই উচিত ও সঙ্গত হবে না। চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো দুর্বলতা, ভারী যন্ত্রপাতির অভাব, টার্মিনাল-ইয়ার্ডের সঙ্কট, চ্যানেলের নাব্য সমস্যা ইত্যাদির প্রেক্ষিতে ভারতকে এ বন্দর ব্যবহার করতে দিলে দেশের সমূহ ক্ষতি হবে। নিজের ক্ষতি করে অন্যের লাভ ঘরে তুলে দেয়ার আত্মঘাতী চিন্তা তাই পরিহার করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন