শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

| প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতি হিসেবে আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্যের দাবি উচ্চে তুলে ধরার ঐতিহাসিক দিন। মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ জাগ্রত তারুণ্যের প্রতিনিধিরা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে কূপমন্ডক শাসকদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিতে সামনে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সেই আত্মত্যাগের বিনিময়ে তৎকালীন শাসকরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছিল। অন্যদিকে ভাষার জন্য জীবন দেয়ার বিরল ইতিহাস রচনার সুবাদে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। হাজার বছরের লালিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মমর্যাদার দাবিকে অগ্রাহ্য করার বিরুদ্ধে বায়ান্নতে রুখে দাঁড়ানোর শাণিত চেতনার পথ বেয়ে দেশের মানুষ পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, স্বাধিকার সংগ্রাম এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার মধ্যে মহান ভাষা শহীদদের আত্মদান এবং এ দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ফল্গুধারার মতো প্রবহমান ছিল। আজকের এই দিনে আমরা মহান ভাষা শহীদদের অমলিন স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।
ব্রিটিশ ভারতে বাংলা ভাষাভাষীরা সংখ্যার দিক দিয়েই নয়, ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার দিক দিয়েও অগ্রগণ্য ছিল। ব্রিটিশমুক্ত ভারতে লিঙ্গুয়াফ্রাংকা কী হবে, তা নিয়ে যখন প্রশ্ন ওঠে তখন উর্দু ও হিন্দির পাশে বাংলার দাবিও উঠে আসে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ওই দাবি পেশ করেন এবং বলেন, বাংলার লিঙ্গুয়াফ্রাংকা হওয়ার যোগ্যতা অন্য দুই ভাষার চেয়ে কোনো অংশেই ন্যূন নয়। তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই অভিমত অনেকেরই পছন্দ হয়নি। তারা বাংলার পক্ষে দাঁড়াতে দ্বিধা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বাংলার দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। এদের মধ্যে সে সময়ের প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত আছেন। তিনি হিন্দির পক্ষে রায় দেন। অথচ তিনিই উপমহাদেশে প্রথম কবি, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এখানে সংক্ষেপে স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলা সর্বভারতীয় ভাষাসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভাষা হিসেবে গণ্য হলেও বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যকার একটি শ্রেণী বিভিন্ন সময়ে এ ভাষাকে যথাযথ মূল্য দিতে চায়নি। এই ভাষায় প্রথম সাহিত্যচর্চা করেছেন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকরা। শেষ পর্যন্ত তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকের অত্যাচার-নির্যাতনে দেশছাড়া হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ পাওয়া গেছে নেপালের রাজদরবারে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বাংলা ভাষায় ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ করতে দেয়নি। বলেছে, যারা এটা করবে, তারা রৌরব নরকে যাবে। মধ্যযুগেও বাংলা ভাষাবিদ্বেষ লক্ষ্য করা গেছে। বিদ্বেষীদের উদ্দেশে তাই কবি আবদুল হাকিমকে বলতে হয়েছে, ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয়ন জানি।’ উপমহাদেশ ও বাংলা ভাগের পর পাকিস্তানের শাসকরা বাংলার মর্যাদা দিতে রাজি হয়নি। তাদের নারাজির প্রতিবাদেই সংগঠিত হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষা শহীদরা বুকের রক্ত ঢেলে বাংলার মর্যাদা সুরক্ষা করেন। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য, এ দেশের মানুষ ভাষা পরিচয়ে বাঙালি। ধর্মীয় পরিচয়ে অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। এই দুই পরিচয়ের কোনোটিই পরিত্যাগযোগ্য নয়। এই দু’য়ের মেলবন্ধনেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এই দুই পরিচয়ের একটিও অস্বীকার করার অর্থ হলো, জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করা।
বাংলাদেশের যে পরিচয়, স্বাতন্ত্র্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস তা সংরক্ষণ ও অব্যাহত চর্চা ও অনুসরণ অনুশীলনের মধ্যেই জাতীয় প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ নির্ভরশীল। এর ব্যত্যয় ও বৈপরীত্য দেখা গেলে দেশ ও জাতির জন্য সেটা হুমকিস্বরূপ। রাজনীতি নিয়ন্ত্রক শক্তি হলেও ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা তার সহায়ক না হলে ওই রাজনীতি তার সক্ষমতা হারাতে বাধ্য। এ জন্যই জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাশাপাশি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা ইত্যাদির চর্চা, বিকাশ, প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হচ্ছে, রাজনীতি এখন যথাযথ অবস্থানে নেই। সেখানে বিভেদ-বিভ্রান্তি ব্যাপক। অন্যদিকে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির ওপর বহিরাগত আগ্রাসন মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে চেতনা ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, সে চেতনার তুল্যমূল্যে অনুসরণ দ্রæত অপসৃয়মান। জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য এটা এক অশনি সঙ্কেত। ভাষা আন্দোলন বলি কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধ বলি, সবকিছুর মূলে লক্ষ্য ছিল, জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করা। রাজনৈতিক অধিকার, গণতন্ত্র মানবাধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা এ আকাক্সক্ষার অন্তর্গত অপরিহার্য বিষয়। এমতাবস্থায়, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিনাশী চেতনাই আমাদের সঠিক পথ দেখাতে পারে। আজকের দিনে এ কথা সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমরা ভাষা শহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
jasim uddin ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১:৪৮ পিএম says : 0
good
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন