শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান কাম্য

| প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের শত শত বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকার পরও রোহিঙ্গা মুসলমানরা অপরাজনীতির শিকার হয়ে এখন এক মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। প্রায় চারদশকের সামরিক শাসনে যেমন রোহিঙ্গারা জান্তা সরকারের দমন-পীড়ন ও বৈষম্যনীতির শিকার হয়েছে, একইভাবে যারা গণতন্ত্রের কথা বলে, বৈষম্য দূর করার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেই অংসান সুচি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধানে শুধু ব্যর্থই হয়নি, তার দলের গণতান্ত্রিক শাসনের শুরু থেকেই রোহিঙ্গারা গত দুই দশকের মথ্যে সবচে বড় মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। গত বছরের শেষদিকে শুরু হওয়া রাখাইন রাজ্যে কথিত সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক অভিযানটি ছিল মূলত: এই রাজ্যের জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়িত করার একটি রাজনৈতিক মিশন। জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের মতে সর্বশেষ চার মাসের সামরিক অভিযানে রাখাইনে সহশ্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার এবং সামরিক বাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং দ্বিমুখী নীতির কারণে সেখান থেকে প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন বেশ কঠিন হয়ে পড়ায় এ সময়ে রাখাইনে সামরিক অভিযানে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছে, কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সন্দেহাতীত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়তো সম্ভব নয়।
সেনা অভিযানের নামে নির্বিচার গণহত্যা, শিশুহত্যা ও ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে গত কয়েক মাসে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের কঠোর নজরদারি এবং পুশব্যাক হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্তে¡ও এদের এক বড় অংশই বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পাশাপাশি মালয়েশিয়া, চীনসহ অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতেও হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানের আশ্রয় গ্রহণের খবর পাওয়া যায়। মূলত চারদশক আগে রাখাইনে জাতিগত সংঘাত ও জটিলতার শুরু থেকেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে বসবাস করছে। এসব রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা তৈরী করছে। তা’ছাড়া এমনিতেই অধিক জনসংখ্যার ভারে ন্যূব্জ বাংলাদেশের পক্ষে দশকের পর দশক ধরে প্রতিবেশী দেশের লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর উপর সাম্প্রতিক সেনা অভিযানে আরো প্রায় একলাখ শরণার্থীর চাপ বাংলাদেশের জন্য বোঝার উপর শাকের আঁটির মত। তবে এবার শুধু বাংলাদেশই নয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা গণহত্যার দৃশ্যাবলীর বহুল প্রচার এবং বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ ও চাপের কারণেই সেনা অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তবে রাখাইনের মুসলিম অধ্যুসিত এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার না করে শুধুমাত্র অভিযান বন্ধের ঘোষণা সেখানে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কতটা ভূমিকা রাখবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় গ্রহণ এবং এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়টি ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি মিউনিখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সম্মেলনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার সমস্যা সমাধান ও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়েছেন। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ও প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত: মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও সংখ্যালঘু মুসলমানদের নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার ঘটনাগুলোকে আমলে নিয়ে এর স্থায়ী রাজনৈতিক ও আইনগত প্রতিকারের বিষয়ে প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য মানবিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সফররত নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরজ ব্রেন্দে সসোমবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমার সরকারের উপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরো বেশী চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে আসিয়ানভুক্ত দেশ মালয়েশিয়া মিয়ানমারের উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেছে। মালয়েশিয়া সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য জাহাজ বোঝাই ত্রাণ সামগ্রিও পাঠিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকেও মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং পুনর্বাসনের প্রশ্নে তাদের কোন সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা দেখা যাচ্ছে না। পূর্বদিকে মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। ভূ-রাজনৈতিক কারণে দুই দেশের মধ্যে আরো জোরালো সামাজিক-অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সমস্যা একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যগত কারণেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি আমাদের মানবিক দায় রয়েছে। এ সব বিষয় বিবেচনায় রেখে একই সাথে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, পুনর্বাসন এবং নাগরিক অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আরো জোরদার করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন